তালেব রানাযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে মার্কিন সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাইকেল ওলফের লেখা ‘ফায়ার এন্ড ফিউরি: ইনসাইড দি ট্রাম্প হোয়াইট হাউস’ নামের বইটি ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। ইত্তেফাকের পাঠকদের জন্য বইটি থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর করে প্রকাশ করা হচ্ছে। বইটির মুখবন্ধ লেখা হয়েছে মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও হোয়াইট হাউসের সাবেক চিফ স্ট্রাটেজিস্ট স্টিভ ব্যানন এবং ফক্স নিউজের সাবেক সিইও রজার আইলেস এর কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে। গত বছরের ৩ জানুয়ারি এক নৈশভোজে কথোপকথনের এক পর্যায়ে আইলেস বলেন, ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মেরুদণ্ড নেই। সাদামাটাভাবে সে শুধুই ট্রাম্প। লেখক মাইকেল ওলফ মুখবন্ধের শুরুতে লিখেছেন, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নৈশভোজের আয়োজন হলেও হঠাৎ করেই বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠা স্টিভ ব্যাননের আসতে দেরি হলো। গ্রিনভিচ ভিলেজ টাউন হাউসে পারস্পরিক বন্ধুদের আয়োজিত নৈশভোজে রজার আইলেসকে দেখতে আসার জন্য তিনি আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আইলেস ডানপন্থী গণমাধ্যমের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং ব্যাননের কিছু সময়ের বিজ্ঞ পরামর্শকও। আইলেস শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী বেথকে নিয়ে পৌঁছলেন। তিনি ব্যাননের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯৬ সালে ফক্স নিউজ প্রতিষ্ঠার আগে প্রায় ৩০ বছর ধরে আইলেস রিপাবলিকান পার্টির নেতৃস্থানীয়  কর্মী ছিলেন। এখনো তিনি মনে করেন, ট্রাম্পকে তার মতো করে কেউ জানে না।লেখক লিখেছেন, এই নৈশভোজের ছয় মাস আগেও কেউ কল্পনা করেনি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবেন। ওই সময় যৌন হয়রানির অভিযোগে ফক্স নিউজ থেকে বরখাস্ত করা হয় আইলেসকে। ট্রাম্পের অনেক কিছুই আইলেস পছন্দ করেন। বিভিন্ন সময় তার প্রশংসা করেছেন। তবে তিনি এটা বিশ্বাস করেন যে, ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মেরুদণ্ড নেই। কোনো ‘গেম প্ল্যান’ করার ক্ষমতাও ট্রাম্পের নেই। আইলেসের মতে, ট্রাম্প হলেন ‘কোনো কারণ ছাড়াই এক বিদ্রোহী’। সাদামাটাভাবে সে শুধুই ট্রাম্প।
ফক্স নিউজ থেকে বিতাড়িত হওয়ার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ট্রাম্প আইলেসকে তার বিপর্যস্ত নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন; কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। কারণ উপদেশ শোনার ব্যাপারে ট্রাম্পের অনিচ্ছার কথা তিনি জানতেন। এর এক সপ্তাহ পরই ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেন ব্যানন; কিন্তু ট্রাম্পের জয়ের পর আইলেস তার আক্ষেপকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়েছে। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে তার অবকাশ যাপন কেন্দ্রে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন। তবে রাজনৈতিকভাবে সচেতন আইলেস জানতেন, জয় সব কিছুই বদলে দেয়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে যখন নৈশভোজের বড় অংশ শেষ তখন এসে পৌঁছলেন ব্যানন। ৬৩ বছর বয়সী ব্যানন এসেই আলোচনার কেন্দ্রে। তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন বিশ্ব-জগতের বিশাল তথ্যে যার দায়িত্ব তিনি নিতে চলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের পছন্দ হলো ১৯৫০-এর দশকের মতো ব্যবসা এবং সামরিক ধাঁচের মন্ত্রীসভা। সাত দিনের মধ্যেই মন্ত্রীসভার সদস্য নিশ্চিত করতে হবে। তখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে মাইকেল ফ্লিনের নিয়োগের বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করেছে। ব্যানন বলেন, সে ভালো, সে জিম ম্যাটিস নন, জন কেলিও নন। দায়িত্ব পালনে তার আশেপাশে সঠিক কর্মকর্তাদের দরকার। ব্যানন জানান, তিনি খ্যাতিমান আগ্রাসী কূটনীতিক জন বোল্টনকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা হয়নি কারণ ট্রাম্প ফ্লিনকে পছন্দ করেন। ইসরাইলের জন্য কে ভালো ছিলেন? এই প্রশ্নে ব্যানন বলেন, ইরানের প্রতি ফ্লিনের একটু দুর্বলতা আছে। যাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হচ্ছে সেই টিলারসন শুধু জ্বালানি তেল সম্পর্কেই জানেন।
 
জানুয়ারির ওই সন্ধ্যায় মিলিত হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকে ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করছেন ব্যানন। ইতিহাস ট্রাম্পকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে সেটি তিনি বুঝতে পেরেছেন কিনা ব্যাননের কাছে জানতে চান আইলেস। তখন ব্যানন জানান, ট্রাম্প সেটা বুঝেছেন। প্রথম দিনই আমরা মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরাতে যাচ্ছি। নেতানিয়াহু’র সবাই এখানে। ট্রাম্পের সমর্থক ও কট্টর ইসরায়েলপন্থী ক্যাসিনো বিলিওনেয়ার শেলডন অ্যাডেলসন রয়েছেন, সবাই আছেন আমাদের মধ্যে। ট্রাম্প এটা জানেন কি? ব্যাননের কাছে জানতে চান আইলেস। উত্তরে হেসে ওঠেন ব্যানন। তিনি বলেন, জর্ডানকে পশ্চিম তীর দেওয়া হোক, মিসরকে গাজা। তারা এসব নিয়ে কাজ করুক। সৌদিরা, মিসরীয়রা সবাই পারসিয়া..ইয়েমেন, সিনাই, লিবিয়ার মৃত্যুতে ভীত। এসব খারাপ বিষয়। এক্ষেত্রে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়াও কি ওই রকম খারাপ? জবাবে ব্যানন বলেন, তারা খারাপ মানুষ, কিন্তু বিশ্ব তো খারাপ মানুষেই পূর্ণ। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ব্যানন এসব বলছিলেন, যেন তিনিই একজন মানুষ যে বিশ্বকে নতুন করে নির্মাণ করতে চলেছেন।
তিনি বলেন, চীন নতুন স্নায়ু যুদ্ধের সম্মুখে রয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ওবামা প্রশাসন সেটা বোঝেনি। এটা মার্কিন গোয়েন্দাদেরও ব্যর্থতা। আমি মনে করি, কোমি (এফবিআই’র সাবেক প্রধান) থার্ড-রেটের ব্যক্তি আর ব্রেনান (সিআইএ’র সাবেক প্রধান) সেকেন্ড-রেটের ব্যক্তি। তাদের দুই জনকে বরখাস্ত করা হবে। ব্যানন বলেন, বর্তমান (ওবামা) হোয়াইট হাউস ১৯৬৮ সালের জনসনের হোয়াইট হাউসের মতো। ওবামার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস আইএস’র বিরুদ্ধে শুধু ড্রোনের ব্যবহার করছেন। এই সম্পূর্ণ ব্যাপারে পেন্টাগনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। গণমাধ্যমও ওবামাকে ছাড় দিচ্ছে। আমাদের মতাদর্শ এর বিপরীত হবে। আমি জানি না ওবামা কী করেন? ক্যাপিটল হিলে কেউ তাকে বোঝে না, কোনো ব্যবসায়ী তাকে জানে না। সে কী করেছে? আইলেস ব্যাননের কাছে জানতে চান এ বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান কী? ব্যানন বলেন, এ ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থান আমাদের মতো। রাশিয়ানদের কাছ থেকে ট্রাম্প নিজের জন্য কি অর্জন করতে পেরেছেন? আইলেস জানতে চাইলে ব্যানন বলেন, অনেক, ট্রাম্প রাশিয়া গিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন তিনি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, কিন্তু পুতিন গুরুত্ব দেয়নি, তবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আইলেস এক সময় ব্যাননের কাছে জানতে চান ট্রাম্পের সন্তানেরা কেমন আছে, বিশেষ করে তিনি জানতে চান জামাই জ্যারেড কুশনারের বিষয়ে। ব্যানন বলেন, সে আমার পার্টনার। সে রুপার্ট মারডকের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছে। ফক্স নিউজ থেকে বের করে দেওয়ার পর মারডকের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন আইলেস। রাত প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই নৈশভোজ আড্ডা চলে।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn