আল-হেলাল : বৈষ্ণব কবি রাধারমন,মরমী কবি হাছন রাজা,গানের সম্রাট কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন),বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহ এই পঞ্চরত্ন বাউলের দেশে জন্ম হয়েছে অগনীত সাধকের। আবার কারো এ মাটিতে জন্ম না হলেও দেশের অন্যত্র হতে সুনামগঞ্জে এসে এ মাটির মরমী গন্ধে মাটির গান রচনা করে এ হাওরাঞ্চলকেই তারা গড়ে তুলেছেন সংগীতের তীর্থস্থান হিসেবে। এমনি একজন সফল সংগীত প্রতিভার নাম গীতিকার পীর মোঃ আর্শাদ আলী শাহ। যিনি ১৯১৯ সালের ২২ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর বেলা কিশোরগঞ্জ মহকুমার ভৈরব থানার সাদেকপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মৃত মন্তাজ আলী মাতা মরহুমা আকলিমা বেগম। ছোটবেলা থেকেই তিনি নামাজ রোজা যথাযথভাবে পালন,সঠিক পথের অনুসারী  এবং সদালাপী ও প্রাণবন্ত মনের অধিকারী। জন্মস্থানে যখন ১৬ বছরে পা রাখলেন তখন  তার মনে এক পরিবর্তন দেখা দেয়। জন্মস্থান আর তার কাছে ভাল লাগছেনা। তখন মনে মনে হিজরত করার সদিচ্ছা জাগে তার মনে। একপর্যায়ে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর আবাসিক এলাকায় নানার বাড়িতে চলে আসেন তিনি। সুনামগঞ্জে অবস্থানের ৩ বছর পর একরাত্রে স্বপ্নে দেখতে পান ছাতক থানার দূর্বিণ টিলার পীর দূর্বিণ শাহের শিষ্যত্ব লাভ করেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখার পর থেকেই তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান কিভাবে দূর্বিণ শাহের সাথে দেখা করা যায়। রাত পোহাতে পরদিনই তিনি চলে যান দূর্বিণ টিলায়। সেখানে দূর্বিণ শাহের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি স্বপ্নযোগে সান্নিধ্য পাওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহন করার অনুরোধ জানান দূর্বিণ শাহকে। দূর্বিণ শাহ বলেন,আমি এখনও কাউকে আমার শিষ্য হিসেবে গ্রহন করিনি। যাই হউক আপনি যখন স্বপ্নযোগে আমাকে দেখে আমার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে আমার বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন তাই আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব এসে গেছে। আপনি কিছুদিন পরে আসেন এবং আমাকে এ ব্যাপারে একটু ভাবতে দেন। কিছুদিন গত হওয়ার পর তিনি আবার পীর সাহেবের নিকট হাজির হলেন। ১৯৪১ সালে দূর্বিণ শাহ আর্শাদ আলী শাহকে তাঁর প্রথম শিষ্য হিসেবে বরন করে নিলেন। তারপর পীর সাহেব তাকে সর্বদা পালন করার জন্য কিছু মারেফত বিষয়ে দীক্ষা দিলেন এবং নামাজ রোজা ভক্তি সহকারে পড়ার ও নবীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য সদুপদেশ দিয়ে তার জন্য দোয়া করলেন। সেদিন থেকে দিনের পর দিন কঠোর সাধনায় পীর সাহেবের নিকট থেকে মারেফত ও শরীয়ত সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব জ্ঞান লাভ করলেন পীর আর্শাদ আলী শাহ। এভাবে দূর্বিণ শাহর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহন ও সন্তুষ্টি অর্জন করে পীরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন এবং পীর সাহেব তাকে মোঃ আর্শাদ আলীর স্থলে পীর মোঃ আর্শাদ আলী শাহ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ধীরে ধীরে তার গুনাবলীর দ্বারা লোকসমাজে সুনাম ও পরিচিতি অর্জন করেন। তিনি একজন গীতিকার। তাঁর প্রতিটি গানেই আল্লাহ রাসুলের প্রতি তার গভীর প্রেমের আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ৮/৫/১৯৮৪ইং থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের গীতিকার হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়ে আছেন। সাধনার জীবনে তিনি প্রায় এক হাজার গান লিখেছেন। তার অনেক গান সিলেট রেডিওতে রেকর্ড হয়েছে। ২০০৪ সালের বন্যায় তার প্রস্তুতকৃত পান্ডুলিপিগুলো বানের জলে ভাসিয়ে গেলেও সর্বশেষ ২০১৬ সালে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি তার জনপ্রিয় ২৫টি গান রেকর্ড করে। শিল্পকলায় রেকর্ড করা গানগুলোতে কন্ঠ দেন দূর্বিণ শাহের কনিষ্ট শিষ্য বাউল তছকীর আলীসহ আরো অনেকে। আরশাদ আলী শাহ যৌবনের প্রারম্ভে সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে চাকুরী করেন অত্যন্ত সততার সাথে। বর্তমানে অবসর জীবনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন তালিকাভূক্ত গীতিকার হিসেবে প্রতিবছর অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর সম্মানী ভাতা ভোগ করে যাচ্ছেন। বয়সে তিনি তার সংগীত ওস্তাদ দূর্বিণ শাহের দু বছরের বড়। দূর্বিণ শাহ আজ ইহজগতে না থাকলেও দূর্বিণ শাহের এই প্রথম শিষ্য এখনও জীবিত আছেন বার্ধক্যৈ উপনীত হওয়ার পরও। তিনি জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহের প্রথম শিষ্য এ আত্ম অহংকার নিয়েই বেঁচে থাকতে চান বাকি জীবন। ২৫ মে মঙ্গলবার ২০২১ইং সাংবাদিক আল-হেলালের বাসভবনে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর ওস্তাদ জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহ ও গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশা সম্পর্কে অনেক মূল্যবান কথা বলেন। গানের সম্রাট কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন),বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহ এই ত্রিরত্ন বাউলকে আমি অত্যন্ত কাছে থেকে সংগীত সাধনা করতে দেখেছি। তারা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি আদর যত্ন ও ভালবাসায় অসম্ভব দায়িত্বশীল ছিলেন। বয়সে বড় হওয়ায় দূর্বিণ শাহের মাতা বাউল কামাল পাশাকে নিজের বড় ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আমার ওস্তাদ দূর্বিণ শাহ সুনামগঞ্জে আসলেই আমার বাড়ীতে উঠতেন। এবং আমার বাড়িতে অবস্থান করেই বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করতেন। বাউল কামাল পাশা বিভিন্ন সময় আলীমাবাগ মিনিষ্টার বাড়ি ও সুনামগঞ্জ কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে অবস্থান করতেন। তারা তিনজনই জীবনের অনেক মূল্যবান সময় একসাথে কাটিয়েছেন সুনামগঞ্জের আফতাবনগর,হাছননগর,তেঘরিয়াসহ বিভিন্ন মহল্লায় অনুষ্ঠিত বাউল গানের প্রোগ্রামে। একবার আমার কাছ থেকে নগদ টাকা কর্জ নিয়ে বাউল কামাল পাশা ও শাহ আব্দুল করিম লঞ্চযোগে দূর্বিণটিলায় যান। সেখানে ছাতক পেপার মিলে প্রোগ্রাম শেষে আবার শহরে ফিরে আসেন। শহরে এসে আমাকে খবর  দিয়ে কাছে ঢেকে নিয়ে কামাল ভাই আমার কাছ থেকে নেয়া টাকা আমাকে ফেরত দেন। আমি বলি আপনি আমার ওস্তাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে গিয়েছেন আমিতো আমার ওস্তাদের নামে এ টাকা আপনাকে উৎসর্গ করেছি। তাই আমি আর এ টাকা ফেরত নেবোনা  নিতে পারিনা। কিন্তু কামাল ভাই নাছোড়বান্ধা  তিনি আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে  প্রায় জোর করে টাকা সমজিয়ে দিলেন। এতো টাকা নয় বরং দোয়া মনে করে আমি একজন মুরুব্বী মহান সাধকের কাছ থেকে টাকা সমজিয়ে নিলাম। তিনি “আকাশটায় কাপছিল কেন জমিটায় হাসছিল কেন চামুয়া নদী ভরিলো কেন সেইদিন সেইদিন/বিশ্বনবী জন্ম নিলেন যেইদিন। আপে আল্লাহ রব জলিল পাটাইলেন জীব্রাইল/মেহরাজে যাইতে রাসুলাল্লাহ। যার সনে যার ভালবাসারে আছে যতদিন/ততদিন সে তাহারে বাসিবেনা বীনরে এবং ও পচা জারমুনি ৬ দফার বাতাসে তুমি টিকবায়নিসহ বেশ কয়েকটি কামালগীতি গান পরিবেশন করে শুনান এ প্রতিনিধিকে। সর্বশেষে তার পীর ও ওস্তাদ দূর্বিণ শাহর একটি গানও পরিবেশন করেন।  এসময় সংস্কৃতিসেবী মোবারক হোসেন উপস্থিত ছিলেন। জানতে চাইলে দূর্বিণ শাহের পুত্র বিশিষ্ট গীতিকার আলম শাহ বলেন,পীর আর্শাদ আলী শাহ আমার বাবা দূর্বিণ শাহের ছাত্র। তিনি আমার পিতা দূর্বিণ শাহকে পীর ও ওস্তাদ মান্য করেছেন আজীবন। দূর্বিণ শাহের আরেক শিষ্য হাছননগর নিবাসী প্রবীণ বাউল শিল্পী তছকীর আলী বলেন,পীর আর্শাদ আলী শাহ একজন ভাল গীতিকার। তিনি আমার ওস্তাদ দূর্বিণ শাহের অন্যতম শিষ্য। নিচে গীতিকার পীর আরশাদ আলী শাহ এর দুটি গান উপস্থাপন করা হলো।     

(১)

মৌলার হাতে কত রঙ্গের খেলা রাইখাছে।।

ঝুনিপোকার লেজের মাঝে কারেন্ট বসাইছে।।

ব্যাঙ্গের ভিতর মানিক আছে আশিকজনা পাইতেছে

আসিক মাসুকের খেলা দমের সাথে খেলতেছে।।

সমুদ্রের পানির নীচে কত রঙ্গের কাফনা আছে

ভিতরে তার মুতি আছে,সন্ধানে উঠাইতেছে।।

কওরাল পাখি গাছের উপর,ধ্যানে বসিয়াছে

ঝাপটা দিয়া মাছ ধরে ছঙ্গল মাইরা ঠেইকাছে।।

পানিখাউড়ি ডুবে গিয়া মাছ ধরিয়া উঠিতেছে

কেবা অন্ধ কেবা মন্ধ আর্শাদ মিয়ায় দেখতেছে।।

(২)

ওগো আর্শাদ আলী মিয়া

একদিন ঠেকিবায় তুমি মাটির তলে গিয়া।।

নামাজ রোজা না করিয়া ফকিরালী কি দিয়া।।

জামাতে নামাজ পড় ইমাম ধরো গিয়া

সারাজীবন কাটাইলায় গাছতলায় বসিয়া।।

৪ তরীকায় নবী আমায় নিবেন তরাইয়া

যার খাতিরে আসমান জমিন সব গেল হইয়া।।

পরকে বুঝাইতে পারো নিজে বুঝনা

হাদিস কোরআন না মানিয়া মুসলমান কি দিয়া।।

হেলায় হেলায় গেলরে দিন রঙ্গঢঙ্গে কাটিয়া

মউতের কালে আর্শাদ মিয়া,কাঁন্দিবে ঝড়াইয়া।।

 

 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn