সালমান তারেক শাকিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুতি থাকলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে দুই শীর্ষ নেতার দিকে তাকিয়ে আছে বিএনপি। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিষ্কার নির্দেশনা ছাড়া কোনোভাবেই নির্বাচনি কাজে মনোযোগী হতে পারছেন না নেতৃত্বে থাকা সিনিয়র নেতারা। একইসঙ্গে নির্বাচনে দুই শীর্ষ নেতার কী  অবস্থান থাকবে,সে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচিত হলেও সিনিয়র নেতারা এ নিয়ে এখনও অন্ধকারে রয়েছেন। ইতোমধ্যে সারাদেশে জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোল বেজে ওঠায় টানাপড়েন তৈরি হয়েছে দলটির নেতাদের মধ্যে। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দলের এই সংকটের কথা জানা গেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন— কারাবন্দি খালেদা জিয়া ও লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের কাছ থেকে এখনও নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশনা আসেনি। যদিও নির্বাচনের সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। এখনও নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেমে-থেমে চলছে। দলীয় নেতাদের ভাষ্য— খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান কারও কাছেই এপ্রসঙ্গটি উত্থাপন করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে দলীয় চেয়ারপারসনকে কারাবন্দি অবস্থায় রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি উত্থাপন করা হলে এর ফলাফল কী হবে, এ সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছেন বিএনপি নেতারা। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আগামী অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে।  এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার আগে প্রথম শর্ত হচ্ছে, নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে। শক্ত আন্দোলন করে সরকারকে দাবি মানাতে বাধ্য করা না গেলে, উদ্ভূত পরিস্থিতি সহনীয় রাখতে বিএনপিকেও ভূমিকা রাখতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং দলের কারাবন্দি  প্রধানকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।’ 

চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা মনে করেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপিকে তিনটি বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। প্রথমত, নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কী ভূমিকা থাকবে। এ বিষয়টিই বিএনপি নেতাদের কাছে সর্বাগ্রে বিবেচ্য হচ্ছে। তাদের দুজনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে,তাদের অবস্থান কী হবে। আর এ বিষয়ে তাদের কাছে নেতাদের কেউই পরামর্শ দিতে যাবেন না। ফলে বাস্তবতার নিরিখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে। তাদের অবস্থান জানার পরই বিএনপি নির্বাচনি স্ট্যান্ড তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন মোকাবিলা করতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই ঐক্যের ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান। তৃতীয়ত, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা। এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের জন্য পূর্বশর্ত আছে। সেগুলোর যদি সুরাহা না করে, তাহলে বুঝতে হবে নির্বাচন সরকারের নীলনকশার অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হবে, এটা আমরা মনে করবো। তারপরে ঠিক করবো যে, আমরা কী করবো।’ নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, দুই শীর্ষ নেতার নির্দেশের অপেক্ষা করার পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে কিছু-কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এর মধ্যে আগামী নির্বাচনের ইশতেহার, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি মানাতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সহমত গড়ে তোলা। এছাড়া প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে আগামী নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ নিয়েও ভেতরে-ভেতরে কাজ করে চলেছে বিএনপি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয়টি বিএনপিকে আশাবাদী করে তুলেছে। সূত্র জানায়, নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নে খালেদা জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভিশন-এ থাকা বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্তসার ইশতেহারে যুক্ত করা হবে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে ১২-১৩ জনের একটি টিম কাজ করছে।
জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দলের নির্বাচনি প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। আর ইশতেহারে কী থাকবে, এসব নিয়ে আমরা ভিশন ২০৩০-এ বলে দিয়েছি। এর বাইরে তো আমরা যাবো না। আমরা ক্ষমতায় গেলে এগুলো করবো। নির্বাচনের আগে বিষয়গুলো আমাদের ইশতেহারে আসবে— এটাই আমাদের ঘোষিত টার্গেট।’এদিকে, বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানান, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, এটা এখনই বলা মুশকিল। আগামী জুনের পর একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের আন্দোলনের বিষয় মাথায় রেখে এখনই বলা কঠিন যে, পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী হবে। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ইতোমধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয়টি সামনে এসেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব সরকারের না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলন, ‘২০১৪ সালেও জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকো’র সঙ্গে বৈঠকের আগে সংলাপ সম্ভব না বলে জানিয়েছিল ওই সময়ের সরকার। পরে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় এবং তা ব্যর্থ হয়। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেও সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার ভাষ্য— বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, জ্বালানি নীতি, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আর এর ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হতে পারে একাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্র, এমন সম্ভাবনার কথা জানালেন এই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে বিএনপির কোনও নেতা এখনই মুখ খুলতে নারাজ।যদিও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে পথ বাতলে দিলেন জাতীয়তাবাদী ধারার প্রবীণ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপির যেটা করা দরকার, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা কারাগারে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলবেন। কথা বলে তারা একত্রে সিদ্ধান্ত নেবেন। এর বাইরে কিছু করার নেই।’ কারণ, হিসেবে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের ব্যাখ্যা— ‘তারা তো যখন প্রয়োজন দেখা করছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তো কথা বলছে সুযোগ অনুযায়ী। কথা বলে, সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা কীভাবে প্রতিফলিত হয়, সেটা তাদের ভাবতে হবে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। নির্বাচন দেরি আছে। অস্থির হওয়ার সুযোগ নেই। সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেই সমাধান আসবে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn