আলমগীর হোসেন।।

সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হচ্ছে যেকোনো সময়। রোববার আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় পুনঃবিবেচনা চেয়ে তাদের করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।মুফতি হান্নান ছাড়াও অন্য দুই জঙ্গি শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল এবং দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপন। এ মামলার বাকি দুই আসামি মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে হাই কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। আপিল না করায় তাদের ওই সাজাই বহাল থাকে। দণ্ডিত পাঁচ আসামির সবাই কারাগারে আছেন। তাদের মধ্যে মুফতি হান্নান আছেন গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে। এই রিভিউ খারিজের মধ্য দিয়ে তাদের সকল আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, এই তিন জঙ্গি কারাবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা করতে পারবেন। সেটি করতে হবে সাত দিনের মধ্যে। দেশে এককভাবে সবচেয়ে বেশি ও বড় ধরনের হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে এই প্রথম কোনো মামলার চূড়ান্ত ফায়সালা হলো। যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রায় শেষ ধাপে এসেছে।

আইনজ্ঞদের মতে, দণ্ড কার্যকরের আগে মুফতি হান্নান ও তার দুই সহযোগীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন সংবিধান অনুসারে শেষ সুযোগে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন। এর আগে ঝালকাঠিতে দুই বিচারককে বোমা মেরে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।এর মধ্যে জেএমবির শীর্ষ দুই নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ।এ মামলার অপর আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় গতবছর ১৬ অক্টোবর।

শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর হয় কুমিল্লা কারাগারে। সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও আবদুল আওয়ালকে ফাঁসি দেওয়া হয় ময়মনসিংহ কারাগারে। খালেদ সাইফুল্লাহর ফাঁসি হয় পাবনা কারাগারে।আর কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয় আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুনকে । সর্বশেষ আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় খুলনা জেলা কারাগারে। মুফতি হান্নানের রায় কার্যকর প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রায়ের কপি যাওয়ার পর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছার তিন সপ্তাহের ভেতর দণ্ড কার্যকর হবে। মুফতি হান্নানের আইনজীবী মো. আলী পূর্বপশ্চিমকে বলেন, মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, রমনার বটমুলে বোমা হামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এ মামলা ছাড়াও আরেকটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড রয়েছে আর অন্যগুলো বিচারাধীন।

যেভাবে ঘটনা ঘটে
এক যুগ আগে ২০০৪ সালের ২১ মে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। এ সময় তিনি সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। হামলায় পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক কামাল উদ্দিনসহ তিনজন নিহত হন। আনোয়ার চৌধুরী, সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল হোসেন, জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত আবদুল হাই খান, স্থানীয় সাংবাদিক মহিবুর রহমানসহ ৭০ জন আহত হন। আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটালি ইউনিয়নের প্রভাকরপুর গ্রামে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। তিনি ২০০৪ সালের ১৫ মে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন। এর পাঁচ দিন পর সিলেটে গিয়ে গ্রেনেড হামলার শিকার হন।

মামলা এবং বিচার
ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করে পুলিশ। তদন্তের শুরুতেই ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা ছিল বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে। পুলিশ ঘটনার পর প্রথম নয় দিনে নয়জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।মূলত ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে হুজির সিলেট অঞ্চলের সংগঠন শরীফ শাহেদুল আলমকে গ্রেপ্তারের পর এই হামলার ঘটনায় হুজি-বি ও মুফতি হান্নান জড়িত থাকার কথা জানতে পারে তদন্তকারী সংস্থা। এরপর তদন্ত গতি পায়। এরপর ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকায় মুফতি হান্নান গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় করা দুটি মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক) অভিযোগপত্র দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ জুন। ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সামীম মো. আফজাল মুফতি হান্নানসহ তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) হাইকোর্টে শুনানির জন্য আসে। ২০০৯ সালে আসামিরা আপিল করেন। ৬ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। নয় দিন শুনানি নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে বিচারিক আদালতে দেওয়া দণ্ড বহাল থাকে। গত বছরের ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা তিন আসামির মধ্যে হান্নান ও শাহেদুল ১৩ জুলাই আপিল করেন। এই আপিলের ওপর ৩০ নভেম্বর শুনানি শুরু হয়। শুরুতে আপিল না করা আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত হিসেবে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শেষ করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে আদালত বলেন, ‘আপিল ডিসমিসড।’ আপিল বিভাগের রায় হাইকোর্ট হয়ে নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং তা গত ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়। সেখানেই আসামিদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।এরপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদন করেন তিন আসামি। শুনানি শেষে রোববার আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।

কে এই মুফতি হান্নান
মুফতি আব্দুল হান্নান জঙ্গি সংগঠন হুজি-বি ও হরকাতুল মুজাহিদীনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলা, ২০০১ সালে রমনায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়৷ তাঁর জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তিনি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। এরপর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ওই দেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরের বছর ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে ভর্তি হন৷ সেখান থেকে তিনি সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে মুজাহিদ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেন। এরপর করাচির ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করেন।

মুফতি হান্নান ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরেন এবং পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন। অবশ্য এর আগেই আফগানফেরত এদেশীয় মুজাহিদরা হুজি-বি গঠন করেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৪ সালে হুজি-বিতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি কোটালীপাড়া উপজেলার থানা প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সাংগঠনিক দক্ষতায় অল্প দিনের মধ্যে তিনি হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন। হুজিতে থাকার পাশাপাশি মুফতি হান্নান হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়েও কার্যক্রম চালাতেন বলে জানা গেছে।

১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এ দেশে গোপন জঙ্গি সংগঠন হুজি-বির নাশকতা শুরু হয়। হুজি-বির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে মুফতি হান্নান ও মুফতি আবদুর রউফের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ হামলা হয় বলে হান্নানের জবানবন্দিতে উল্লেখ রয়েছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও দেড়শ’ জন আহত হন। যদিও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ঘটনায় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ফলে জঙ্গিদের বিষয়টি তখন আড়ালেই থেকে যায়। এরপর একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়। তাতে আটজন নিহত হন।
২০০০ সালের জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে প্রথম আলোচনায় আসেন মুফতি হান্নান ও তাঁর দল। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে থেকে তৎপরতা চালান।

২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তাঁর সমাবেশে। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি। তার আগে ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বির জঙ্গিরা। হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn