গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব বাংলাদেশ থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তিন মাধ্যম ব্যবহার করতে ব্যবহারকারীদের কোনও টাকা না লাগলেও মূলত বিজ্ঞাপন থেকেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া নিজের একটি পোস্ট বা ছবি ফেসবুকের মাধ্যমে অধিক সংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতেও টাকা দিতে হয়। টাকা দিয়ে পোস্ট বুস্ট করলে তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়। এর মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট মাধ্যমগুলো হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে।

গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব এর লোগো
প্রযুক্তিখাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব হাজার কোটি টাকা এ দেশ থেকে নিয়ে গেলেও সরকারকে কোনও কর দিচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলো এ দেশে নিবন্ধিত না হওয়ায় বা কোনও অফিস না থাকায় তাদের করের আওতায় আনতে পারছে না সরকার। বৈধ চ্যানেলে না থাকার কারণে (বৈধ চ্যানেলে গেলেও তার পরিমাণ খুব অল্প) ঠিক কত পরিমাণ অর্থ বছরে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে হাজার কোটি টাকার বেশিই যে দেশের বাইরে যায় বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, দেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, টেলিকম অপারেটর, বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের দিকে বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে। টেলিকম অপারেটরগুলোর সাম্প্রতিক ট্রেন্ড দেখলে দেখা যায়, খবরের কাগজে তাদের বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে প্রচার-প্রচারণা চালানোর জন্য পৃথক বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনও করে থাকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আজকের ডিল’ এর প্রধান নির্বাহী ও বেসিস পরিচালক ফাহিম মাসরুর বলেন, ‘বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কাজের জন্য বছরে ২৫ হাজার ডলার বৈধ পথে বিদেশে নিতে পারে। যে পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে পাঠানো হয় তার বেশির ভাগই গুগল-ফেসবুক-ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পেছনেই ব্যয় হয়। এই টাকায় আসলে হয় না, আমি মনে করি এই টাকার পরিমাণ বছরে ৪০-৫০ হাজার ডলার করা উচিত।’ বৈধ চ্যানেলে বেশি পরিমাণ ডলার পাঠানোর ব্যবস্থা থাকলে নন চ্যানেলে টাকা পাঠানো তখন কম যাবে বলেও মনে করেন তিনি। দেশের প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে মাসে গড়ে ৮-১০ হাজার ডলার খরচ করে থাকে। সেই হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান বছরে ১ লাখ ডলারের বেশি খরচ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে প্রমোশনের জন্য এই ব্যয় করে থাকে। অনলাইনে বিজ্ঞাপন না দিলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্যের অর্ডার আসা কমে যায়। ফলে বিজ্ঞাপন না দিয়ে উপায় থাকে প্রতিষ্ঠানগুলোর। অন্যদিকে ফেসবুক নির্ভর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সাইটের ও নতুন পণ্যের প্রচারের কারণে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ জানান, এফ-কমার্স (ফেসবুক নির্ভর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন ৫-১০ ডলারের বিজ্ঞাপন বুস্ট (বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ খরচ) করে থাকে। আর্থিক সক্ষমতা কম থাকায় স্বল্প পরিমাণে করে হয় বলে জানান তিনি। বর্তমানে ১০-১৫ হাজার এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় পেজগুলোই সাধারণত নিজেদের পেজ থেকে বুস্টিং করে থাকে যোগ করেন তিনি। নিজের ও প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সির প্রধান নির্বাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সাধারণত আইটি সার্ভিস দিই। এর বিনিময়ে আমরা কমিশন পাই। সেই কমিশনের ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) চায় সরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মূলত বিজ্ঞাপন জোগাড়ের কাজ করে থাকি। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আমরা কোনও পেমেন্ট নিই না। গ্রাহক সরাসরি ফেসবুক বা গুগলকে পেমেন্ট করেন। ওরা আমাদের কমিশন পাঠায়।’

ফেসবুক-গুগলকে করের আওতায় আনতে চাওয়ার সরকারি উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা করা হলে সরকার বিপুল অংকের অর্থ আয় করতে পারবে। তবে তার আগে গুগল-ফেসবুক-ইউটিউবকে এ দেশে নিবন্ধন বা অফিস খুলতে বাধ্য করতে হবে। যদি ফেসবুকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সরকারকে টাকা দিতে না চায় তাহলে তাদের কঠোর ভাষায় জানাতে হবে, এ দেশের কোনও বিজ্ঞাপন যেন ওরা না দেখায়। তাহলে ওরা একটা ইতিবাচক আয়োজনে আসতে বাধ্য হবে। ওদের আয় বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে ঠিকই ওরা আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।’ তিনি বলেন, ‘এই খাতে কাজ করতে এসে দেখছি বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে গুগল-ফেসবুক-ইউটিউবসহ অন্যরা। যদিও এর বেশি অংশই বৈধ চ্যানেলে যাচ্ছে না।’ নিজেকে উদ্ধৃত না করে একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনলাইনে বিজ্ঞাপন গেলে সাড়া বেশি পাওয়া যায়। স্থির চিত্রের পাশাপাশি ভিডিও অ্যাডও তৈরি করা হয় ফেসবুক, ইউটিউবে প্রচারের জন্য। প্রয়োজনে আমরা বড় বিজ্ঞাপনও তৈরি করে ইউটিউবে প্রচার করতে পারি।’ নিজের প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বার্ষিক বাজেট না জানালেও তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই বাজেটের বরাদ্দ বাড়ছে।’ এমনকি দেশে মোবাইল ফোন আমদানিকাররাও নতুন ফোন বিপণনের সময় খবরের কাগজের পরিবর্তে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে বেশি পছন্দ করেন। জানতে চাইলে শাওমি মোবাইল ফোনের অনুমোদিত পরিবেশক সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেডের (এসইবিএল) প্রধান নির্বাহী দেওয়ান কানন বলেন, ‘আসলে প্রচলিত গণমাধ্যমের চেয়ে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিলে বেশি সাড়া পাওয়া যায়। এজন্য আমাদের বাজেটের বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন যায় ডিজিটাল মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের উপস্থিতিই এর বড় কারণ।’

প্রসঙ্গত, দেশে ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহারকারী বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য ও সেবার প্রচার ও প্রসারের জন্য বিকল্প মাধ্যম হিসেব পছন্দের তালিকায় রেখেছেন গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব। স্বল্প অর্থ খরচে বিপুল সংখ্যক টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছতে এই মাধ্যমগুলো এখন পছন্দের শীর্ষে ব্যবসায়ী ও সেবাপণ্য নির্মাতাদের। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৮ লাখ ২৯ হাজার। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারী ৩ কোটির বেশি। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে অনলাইন দুনিয়া বড় মাধ্যম হয়ে ওঠার এটাও একটা কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের ৯ অক্টোবর একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাংলাদেশে আসেন ফেসবুকের দক্ষিণ এশিয়া পলিসি প্রোগ্রামের প্রধান রিতেশ মেহতা। সে সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে ফেসবুকের মুনাফা করার কোনও উদ্দেশ্য নেই। সামাজিক এনগেজমেন্ট বাড়ানোর জন্য আমরা এসব করেছি।’ বাংলাদেশ থেকে বুস্টিং, বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য খাত মিলিয়ে ফেসবুক কী পরিমাণ অর্থ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি আয় করে জানতে চাইলে রিতেশ মেহতা বলেছিলেন, ‘আমার এই বিষয়ে কথা বলা বারণ।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn