আফসানা বেগম (ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

বসন্ত’ শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম অসুখের নাম হিসেবে। বাবা বলেছিলেন তার স্কুলের এক বন্ধু বসন্ত হয়ে মারা গেছে। ছোটভাইও একদিন বলেছিল, ওমুকের না সারা গায়ে চার আনা সাইজের বসন্তে ভরে গেছে। সে অনেক পরের কথা যখন বুঝেছি বসন্ত এক মন কেমন করা বাতাস, সন্ধ্যা হলেই এলোমেলো করে দিয়ে যায়। ধীরে ধীরে আরো জানলাম মানুষ তার বয়স মাপে বসন্ত দিয়ে… উনিশ বসন্ত পেরিয়ে তার সাথে দেখা হলো। হয়ে গেল সব অন্যরকম; কারণ ছাড়াই দিনভর মনের মধ্যে বাঁশি বাজছে, হাহাকার লেগেই আছে। তবু ভাবি, কবিতা আর গানে মাতাল বাতাস, উদাস দুপুর, ফোটা ফুলের মেলা, কোকিলের কুহু, হৃদয় খোলার তাড়া, আরো নানান কিছুর কথা না বললে কি আমার মনে বসন্ত আসত? উত্তর পাই না।

যা হোক, যে এলাকায় থাকি সেখানে বছরজুড়ে বসন্তের আবহাওয়া। গাছের নীচের ডালের পাতা ঝরছে, উপরের ডালে কচি পাতা উঁকি দিচ্ছে। আমগাছের নীচের দিকে পাকা আর মাঝামাঝি সবুজ আম ঝুলছে অথচ মগডালে মুকুল মাথা উঁচু করে আছে।
ছাতিম গাছের ডালে সারাবছর কোকিল গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তবে এখানে বসন্তের কথা কেউ বলে না, বসন্ত নিয়ে বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস বা চাঞ্চল্য দেখায় না। ঋতু নেই, ঋতু নিয়ে মাথাব্যথাও নেই।

এই দীর্ঘমেয়াদী বসন্তের মধ্যে থেকেও, বাংলাদেশে যেদিন বসন্ত আসে, সেদিন আমার মনে হয় বসন্ত এল। তার আগে কোকিলের ডাকের আবেদন যেন কাকের ডাকের থেকে আলাদা কিছু নয়। অথচ সেদিন থেকে আহ্বানের মতো শোনায়। আমার থাকার জায়গাটার নামকে বাংলায় বললে দাঁড়ায় ‘বাতাসের গান’। বরাবরের নামটাও তখন হঠাৎ সার্থক মনে হয়।

অন্য কথা, কৈশোরে বরাবর কেন যেন নতুনকে পাবার আনন্দের চেয়ে পুরনোর চলে যাবার বেদনা আমাকে বেশি আচ্ছন্ন করে রাখত। তাই হয়ত গানের স্কুলে যখন ‘বৈশাখ হে মৌনিতাপস’ কিংবা ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে সমবেত স্বর মেলাতাম, তখনো কানে বাজত অন্য সুর; উথালপাতাল বাতাসের অবহেলাময় দুপুরে বড়ো ভাইয়ের গলা ভেসে আসত, ‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন’। কী চলে যায়, কেন চলে যায় তা বিন্দুমাত্র ধরতে পারতাম না, অথচ চলে যাবার সংবাদ শোনার বিষণ্ণতায় বুকের ভিতর চিনচিন করত। তখনো কেউ বুঝতে দেয়নি যে চলে গেলেই নতুনের আসার পথ সহজ হয়।

নতুন আসুক। শুভ হোক সবার।

  • আফসানা বেগম: লেখক।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn