বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনের কারণে এতদিন পেপ্যালের কার্যক্রম শুরুর অনুমতি ছিল না। অবশেষে আজ ২০ মার্চ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে সোনালী ব্যাংককে পেপ্যালের সঙ্গে কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি বিভাগ আজ এ সংক্রান্ত একটি অনুমতি পত্র সোনালী ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করেছে।  এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের ফরেন রেমিটেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. নওয়াব হোসেন জানিয়েছেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি পেয়েছি। এখন বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আমরা পেপ্যালের সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে পারব। আমরা আশা করছি, শিগগির বাংলাদেশে পেপ্যাল তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। পেপ্যালের সঙ্গে চুক্তি করার পর আমরা তাদের সাথে ইন্টিগ্রেশন করতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করব। এ জন্য আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না। খুব তাড়াতাড়ি সু-সংবাদ দিতে পারব।’

নওয়াব হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্প্রতি বিদেশ থেকে রেমিটেন্স নিয়ে আসতে কিছুটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। আবার এ দেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে টাকা নিয়ে আসছে। কিন্তু পেপ্যাল চালু হওয়ার পর বিদেশ থেকে রেমিটেন্স এবং ফ্রিল্যান্সারদের টাকা আরও দ্রুত আনা সম্ভব এবং প্রক্রিয়াটি সহজ হবে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে এক রাষ্ট্রীয় সফরে অবস্থানকালে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমরা ক্যালিফর্নিয়াতে পেপ্যালের ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে খুব ইতিবাচক একটি মিটিং করেছি। শিগগির এ সংক্রান্ত একটি সুসংবাদ সবাইকে দিতে পারব।’ তবে এই মিটিংয়ের পরবর্তীতে পেপ্যালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘জুম’ বাংলাদেশে চালু হয়েছিল। যা এখনও অব্যাহতভাবে অপারেশন চালু রেখেছে।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) দেশে পেপ্যাল নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালে এসে এটি বাস্তবায়নের জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করতে থাকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সে বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে পেপ্যাল চালু হচ্ছে বলে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। তৎকালে বেসিসের সভাপতি মাহবুব জামান এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর (বছরের তৃতীয় প্রান্তিক) মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পেপ্যাল তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।’ তবে তা চালু হয়নি।

একই বছরের ডিসেম্বরে এটুআই-এর পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, পেপ্যাল বা পেপ্যালের মত যেসব প্রতিষ্ঠান, গুগলের অ্যাডসেন্স তারাও বলেছে যে মানি ট্রান্সফারের ব্যাপারটা তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ কেননা যারা গুগলের অ্যাডসেন্স নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য টাকা নেয়াটা খুবই কঠিন এবং গুগলের জন্য টাকা দেয়া বা নেয়াটা কষ্টকর। তাই টাকা বাংলাদেশে আনা বা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো দুটোই বিবেচনার বিষয়।

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিমালা রয়েছে সেগুলো মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে। এগুলো সব কিছু মিলিয়ে আমি বলব, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব নিবিড় ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং পেপ্যালও খুব দ্রুত বাংলাদেশে আসবে এবং ফ্রিল্যান্সারদের জন্য মানি ট্রান্সফারে যেসব জটিলতা রয়েছে সেগুলো কয়েক মাসের মধ্যে অনেকাংশে সমাধান হবে বলে আমি মনে করছি।’

এর কয়েকদিন পরেই দেশের প্রথম ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড মেলায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘আগামী বছরেই (২০১৩ সালে) দেশে পেপ্যাল চালু হবে।’ ২০১৩ সালের এপ্রিলের শুরুতে সিলেটে ই-বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আগামী দেড় মাসের মধ্যে দেশে পেপ্যাল চালু হবে।’ এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানও কয়েক দফায় জানিয়েছিলেন, দেশে পেপ্যাল আসছে। কিন্তু এর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পেপ্যালের আন্তর্জাতিক সদর দফতর থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন। তারা ওই সময় বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকও করেন। সে সময় তারা আইনগত নানা দিক পর্যালোচনা করেন।  বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্টের ঝুঁকি পর্যালোচনা করে একটি মতামত দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর ক্যালিফোর্নিয়ায়। মূলত ওই প্রতিনিধি দলের মতামতের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের শেষ দিকে পেপ্যাল সদর দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আপাতত তারা বাংলাদেশে আসছে না।

২০১৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে পেপ্যাল না আসার অফিসিয়ালি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, এটা ঠিক পেপ্যাল আপাতত বাংলাদেশে আসছে না। তবে কোনো দুর্বলতার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সব নীতি তাদের মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আমাদের জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আলাদা সফটওয়্যার করার পর আমাদের দেশে আসবে। এমন কথা জানিয়ে পেপ্যালের প্রধান নির্বাহী আমাদের চিঠি দিয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করব যত দ্রুত সম্ভব পেপ্যালকে দেশে নিয়ে আসতে।’ ২০১৪ সালে কয়েকবার সজীব ওয়াজেদ জয় আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘পেপ্যাল দেশে আনার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ সেই আশার আলোর প্রদীপ জ্বালাতে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যান তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তবে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবেমাত্র অনুমোদন মিলল। এরপর অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে পেপ্যাল আসার ব্যাপারে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সোনালী ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, পেপ্যাল বর্তমানে পৃথিবীর ১৯৩টি দেশে কাজ করছে। পেপ্যাল ২৬টি মুদ্রায় গ্রাহকদের অর্থ পাঠাতে, গ্রহণ করতে ও অর্থ সংরক্ষণ করার সুযোগ দিয়ে থাকে। এই মুদ্রাগুলো হল অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ব্রাজিলের রিয়েল, কানাডার ডলার, চীনের ইউয়ান (শুধু কিছু চীনা একাউন্টে ব্যবহারযোগ্য), ইউরো, পাউন্ড স্টার্লিং, জাপানি ইয়েন, চেক ক্রোনা, ডেনিশ ক্রোন, হং কং ডলার, হাঙ্গেরীর ফ্রইন্ট, ইসরাইলের নতুন শেকেল, মালেশিয়ার রিঙ্গিত, মেক্সিকোর পেসো, নিউ জিল্যান্ডের ডলার, নরওয়ের ক্রোন, ফিলিপাইনের পেসো, পোল্যান্ডের যোলটি, সিঙ্গাপুরের ডলার, সুইডেনের ক্রোনা, সুইস ফ্যাঙ্ক, নতুন তাইওয়ানের ডলার, থাই ভাত এবং যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন ডলার। এ ছাড়া পেপ্যাল স্থানীয়ভাবে ২১টি দেশে কাজ করে। ১৯৯৩ সালে ইউরোপে কার্যক্রম শুরু করে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn