দ্রুত সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন তুরস্ক, সিরিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধার করা গেলে তা হবে মিরাকল বা অলৌকিক। এরই মধ্যে বাতাসে পচন ধরা লাশের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। তার ভেতর দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন জীবিতদের উদ্ধারে। তারা জানেন, ঘড়ির কাঁটার গতির বিরুদ্ধে সুপারসনিক গতিতে কাজ করতে হবে। একটি জীবন বাঁচাতে পারা তাদের কাছে কতো মূল্যবান। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬ দিন। ক্রমশ পাহাড়সম ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হচ্ছে। কিন্তু মনকে বোঝাতে পারছেন না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আত্মীয়-স্বজনরা। তারা এখনো বুকবেঁধে অপেক্ষা করছেন প্রিয়জনের সন্ধানের আশায়।

তাকে জীবিত দেখার আশায়। ধ্বংসস্তূপের পাশেই অনেক স্থানে তাদেরকে দেখা যাচ্ছে বুক চাপড়ে কান্না করছেন। তুরস্কের কাহরামানমারাস থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক রসুল সরদার বলছেন, ভয়াবহ ঠাণ্ডা। এর মধ্যেও যেসব মানুষ বেঁচে আছেন তারা পরিবারের নিখোঁজ স্বজনদের খবর জানার জন্য দিন-রাত অপেক্ষা করছেন। তাপমাত্রা ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রা বা তারও নিচে নেমে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই হিমশীতল পরিবেশেও এসব স্বজন সেখান থেকে সরে যেতে রাজি নন। তারা বিশ্বাস করেন- এখনো তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পাবেন, সেটা হোক জীবিত বা মৃত। শুধু এই শহরেই মারা গেছেন কমপক্ষে ৬০০০ মানুষ। শহরটির সব জায়গায়ই ধ্বংসযজ্ঞ। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লাগবে। যদিও প্রতিদিনই প্রচুর মানুষকে জীবিত পাওয়া যাচ্ছে তবে যত মানুষ এখনো নিখোঁজ, তার তুলনায় এই সংখ্যা একেবারেই কম। এরই মধ্যে ১১৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পড়ে একজন ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। তারা একটি শিশুকে, একজন মাকে বা যেকোনো একজন ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার করতেই উপস্থিত জনতা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিচ্ছেন। কেউ কেউ কলেমা পড়ছেন। চোখ ভিজে উঠছে এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে। যার ভেতর মানবিকতা আছে, যে ব্যক্তি নিজেকে মানুষ দাবি করেন- তিনি যেই হোন না কেন, যে ধর্মের, বর্ণের, গোষ্ঠীর হোন না কেন- তার হৃদয় কেঁপে উঠছে। 

কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২৫ হাজার ৪০১। তুরস্কে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২১ হাজার ৮৪৮ জন। আহত হয়েছেন ৮০ হাজার ৮৮ জন মানুষ। সিরিয়ায় ৩ হাজার ৫৫৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মারা গেছেন ১৩৮৭ জন এবং বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মারা গেছেন ২১৬৬ জন। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা এখন ২৪ হাজারের বেশি। আল জাজিরার খবরে বলা হয়, অন্য দেশগুলোর মতো আন্তর্জাতিক সহায়তার অংশ হিসেবে সিরিয়ায় ভিকটিমদের জন্য মানবিক ত্রাণ ও মেডিসিন পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সেলিম হোসেন শুক্রবার রাতে বলেছেন, বিমান বাহিনীর কার্গো বিমান বহন করছে তাঁবু, কম্বল, গরম পোশাক, শুকনো খাবার ও ওষুধপত্র। এসব মিলে প্রায় ১১ টনের চালান নিয়ে ঢাকা থেকে শুক্রবার রাতে দামেস্কের উদ্দেশ্যে ছেড়েছে ওই বিমান। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১৭ সদস্যের উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে।

বহুতল কয়েক হাজার ভবন তুরস্কে এখনো মাটির সঙ্গে মিশে আছে। চারদিকে যেন কেয়ামতের আলামত। যতদূর চোখ যায়, শুধু ধ্বংসস্তূপ। এর নিচে চাপা পড়ে আছেন হাজার হাজার মানুষ। গোটা বিশ্ব থেকেই উদ্ধারকারীরা যাচ্ছেন যত সম্ভব মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। তুরস্কের অন্তত ১০টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভূমিকম্পে। বেশি প্রাণহানি হওয়া অঞ্চলগুলো হলো আদানা, আদিয়ামান, দিয়ারবাকির, গাজিয়ানতেপ, হাতায়, কিলিস, মালাতায়া, ওসমানিয়ে এবং সানলিউরফা। তুরস্ক ও সিরিয়াতে প্রাণহানি হলেও ভূমিকম্পে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই কেঁপে ওঠে। ৭.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পকে বলা হচ্ছে এক শতকের মধ্যে তুরস্ক ও সিরিয়ার জন্য সব থেকে বড় বিপর্যয়। তুরস্কে শুরু হয়েছে অন্য এক ঘটনা। রাজধানী আঙ্কারা থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক সিনেম কোসেওগলু বলছেন, বিধ্বস্ত ভবনগুলোর জন্য এর কন্ট্রাক্টর এবং ইন্সপেক্টর কোম্পানি ও অন্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছেন অনেক আইনপ্রণেতা। এরই মধ্যে ওসমানিয়া প্রদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার জনকে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে দু’জনকে। হাতায় প্রদেশে একটি কম্পাউন্ড নির্মাণের জন্য দায়ী বলে অভিযুক্ত তারা। এই কম্পাউন্ডে ছিল ২৫০টি ফ্ল্যাট। ওই কম্পাউন্ডের বা ভবনের সব ফ্লোর মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। ওই দুই ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থসহ দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে বিমানবন্দর থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কারণ, যা ঘটেছে তাতে তারা ফেঁসে যেতে পারেন, এই ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন।

গোটা বিশ্ব থেকে তুরস্কের জন্য যথাসম্ভব সাহায্য পৌঁছালেও সিরিয়াকে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সাহায্য পাঠাচ্ছে না। স্থানীয় আরব প্রতিবেশী দেশগুলো এবং রাশিয়া সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করছে। এরপরেও সেখানে ভয়াবহ ত্রাণ সংকট দেখা যাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করছে এমন একটি বেসামরিক ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেট-এর প্রধান জাতিসংঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের পদক্ষেপ ছিল খুবই বাজে। রায়েদ আল-সালেহ নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘ নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। বিবিসি বলছে, বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের প্রথম ত্রাণবাহী গাড়িবহর তুরস্ক থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করে। তবে হোয়াইট হেলমেট বলছে, ওই রসদ ভূমিকম্পের আগে সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল এবং উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য জরুরি রসদ তাতে ছিল না। ইদলিব থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে জেনেভায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার সময় আল-সালেহ বলেন, ভূমিকম্পের ১০০ ঘণ্টা পর যে ত্রাণবহর উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় পৌঁছেছে তাতে ছিল মাত্র ছয়টি ট্রাক!

ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ৬ দিন পার হয়েছে। সাহায্যের অভাবে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার পরিস্থিতি মরিয়া হয়ে উঠেছে। উত্তর সিরিয়ার একটি হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার মোহাম্মদ হাসাউন বলেন, ভূমিকম্পের পর এখন তাদের কাছে যে চিকিৎসাসামগ্রী রয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি শুক্রবার জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় খাদ্যের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অথচ এই দুর্যোগের আগেই সে অঞ্চলের ৯০ ভাগ মানুষ বিদেশি সহায়তার উপরে নির্ভরশীল ছিল। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের সিরিয়া প্রতিনিধি শিবাঙ্কা ধনাপালা শুক্রবার বলেছেন, ভূমিকম্পের কারণে একপক্ষকাল ৫৩ লাখ সিরিয়ান বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। তিনি বলেন, এই সংখ্যা বিশাল। যে দেশটি এরই মধ্যে গৃহযুদ্ধের কারণে ভয়াবহভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তার ওপর এই সংখ্যা যোগ হয়ে বোঝা আরও ভারী করবে।

ওদিকে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের ১০ প্রদেশে জীবিতদের কাছে যাতে মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছানো যায় তার জন্য আর্মেনিয়ার সঙ্গে সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুরস্ক। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু এ কথা বলেছে। এর ফলে তুরস্কের ইগদির প্রদেশে আলিক্যান সীমান্ত দিয়ে ৫টি মানবিক ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। আর্মেনিয়া বংশোদ্ভূত তুর্কি এমপি গ্যারো পাইলান টুইটে বলেছেন, এই নারকীয় বিপর্যয়ে আমাদেরকে কিছু পণ্য দিন। সংহতি জীবন বাঁচায়!  ওদিকে তুরস্ক ও সিরিয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠাচ্ছে কিউবা। উদ্ধার এবং  মেডিকেল সুবিধা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক যে প্রচেষ্টা তার সঙ্গে যোগ দেবেন এই গ্রুপটি। শুক্রবার হাভানা থেকে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, তাদের এই দলে থাকছে ৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn