লীনা পারভীন

পপুলেশন কাউন্সিল নামক একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে নিয়ে যে জরিপ করেছে, সেখানে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। গবেষণার ফল বলছে, কনের বয়সের ওপর নির্ভর করে যৌতুকের পরিমাণ ওঠা-নামা করে। অর্থাৎ বয়স কম হলে যৌতুকের টাকার দাবি হয় কম আর বয়স যত বেশি যৌতুকের টাকার পরিমাণও বাড়তে থাকে সমান তালে। কতটা অপমানজনক বিষয় একজন নারীর জন্য। এই তথ্য আমাদেরকে বর্তমান সমাজের মানসিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। যতই আমরা নারী শিক্ষার হার বাড়ছে বা সমাজে নারীদের সচেতন অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে গর্ব করি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সমাজের একটি বড় অংশ এখনও একজন নারীকে পুরুষের ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না।

বিয়ের পর নারীকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার প্রবণতা রয়েছে পুরুষের। এই চিত্র ছিল বেগম রোকেয়ার সময়েও। আজকের পুরুষেরা মনে করে, নারীকে তারাই স্বাধীনতা দান করে। আপাত আধুনিক পুরুষেরা বড় গলায় বলেন, আমি তো আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি। এই কথার মধ্য দিয়ে এটাই বুঝাতে চায় যে, নারীকে স্বাধীন চলাচলের অধিকারও তারাই দিয়ে থাকে। এমন পুরুষদের জন্যই হয়তো রোকেয়া তার ‘মতিচূর’ প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘অনুগ্রহ করে এই কর, অনুগ্রহ কর না মোদের’।
বেগম রোকেয়া নারীদেরকে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন বেশি। তিনি জানতেন যতদিন নারীরা নিজেদের পুরুষের সেবাদাস হিসেবে ভাবতে চাইবে ততদিন প্রকৃত অর্থে নারীমুক্তি ঘটবে না। বেগম রোকেয়া জানতেন পুরুষের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে সম্পত্তিকেন্দ্রিক। সে সম্পত্তি তার নিজের হোক বা অন্যের হোক।
‘দীর্ঘকাল হইতে নারীহৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলো অংকুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই ‘দাসী’ হইয়া পড়িয়াছে’–বেগম রোকেয়ার এই যে উপলব্ধি, শত বছরের বেশি সময় আগে বসে তিনি নারীদের দাসত্বের যে কারণকে উল্লেখ করেছিলেন, সেটি কি আজও সত্য নয়? নারীরা কি নিজেই সেই ‘দাস’ মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে? অন্তত কিছু সংবাদ আমাদের এই বিশ্বাস দেয় না।
বিবিএস পরিচালিত সরকারের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৭২ শতাংশ নারী স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হলেও সেটি বাইরে প্রকাশ করে না বা আইনের আশ্রয় নেয় না। কারণ হিসাবে পাওয়া গিয়েছে লোকলজ্জার ভয়, স্বামীর ভয়, পরিবারের সম্মানের ভয় ইত্যাদি। একটু মিলিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয় ঊনিশ শতকে বেগম রোকেয়া যখন বলে যান নারীদের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে আর একবিংশ শতকে এসে আমরা এই সংবাদ দেখি তখন সেকাল আর একালের নারীদের মাঝে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
সমাজের একটি প্রচলিত কথা হচ্ছে নারীরা পুরুষের তুলনায় দুর্বল এবং নারীরা বাইরের কাজের উপযুক্ত নয়। নারীরা আর্থিক বিষয়ে পুরুষের ওপর নির্ভর করে থাকে বলেই নারীদের মাঝে দাসত্বের মানসিকতা বেশি। তারা নিজেদেরকে স্বাধীন না ভেবে অন্যের অধীন বলে মনে করে নিজেকে আড়াল করে রাখে। এই প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন নারীরা কেন অর্থ উপার্জন করতে পারবে না? তাদের কী কম আছে? নারীদেরও পুরুষের মতো সমান হাত পা মাথা আছে। নারীরা উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন করে নিজের ক্ষমতা দিয়েই অর্থ উপার্জন করতে পারে। সুযোগ পেলেই তারা নিজেদের প্রমাণ করে দিতে পারে। এর প্রমাণ আমরা যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশে দেখেছি আবার ২০১৭ সালে এসে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে এমন রিপোর্টও আমাদেরকে আবার শঙ্কিত করে দেয়। আমরা কি তাহলে আবার বেগম রোকেয়ার সময়কালে ফিরে যাচ্ছি যেখানে নারীদের ‘অবরোধবাসিনী’ করে রাখা হতো?
নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য করে দিয়েছে ক্ষমতার কাঠামো। আর ক্ষমতার প্রধান উৎস হচ্ছে সম্পত্তির ওপর ব্যক্তির অধিকার। যেদিন থেকে সম্পত্তির ওপর পুরুষের একক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো সেদিন থেকেই নারী হয়ে গেলো পুরুষের অধীনে। আর এই সম্পত্তি থেকে নারীকে বঞ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার, ঠিক তাই করেছে সমাজ। উপলব্ধিটা বেগম রোকেয়ার হলেও এটি আমার মতো অনেকের। অত্যন্ত কঠিন সত্য তিনি উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় একশ ৩৭ বছর আগে জন্ম নেওয়া একজন সাধারণ বাঙালি মুসলমান থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা সেই নারী। ঊনিশ শতকের সত্যের কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে এই একবিংশ শতকে এসে?
আমরা যারা আজকের দিনে নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার তারাও কী এই একই সত্যের মুখোমুখি নই? দেশের আইন কী বলে? সেটা কি নারীর প্রতি সংবেদনশীল? নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতার বিষয়টি সার্বিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে? হয়নি। এখনও নারীরা সম্পত্তিতে তাদের অধিকারের বিষয়ে রাস্তায় নামে। নারী যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন তাকে বঞ্চিতই থাকতে হয় নিজের অধিকার থেকে। এমনকী, নারীর নিজের অর্জিত সম্পত্তিতেও তার পূর্ণ অধিকার দেয় না এই সমাজ।
তাই এটা সহজেই বলা যায় যে বেগম রোকেয়া যে চিন্তা ঊনিশ শতকে করে গিয়েছেন আজকের সমাজ সেই চিন্তাকেও ধারণ করতে পারছে না পুরোপুরি। বেগম রোকেয়াকে সংগ্রাম করতে হয়েছিলো কিন্তু জীবনের ওপর কোনও হুমকি তিনি তেমন অনুভব করেননি। মৌলবাদীদের হুমকি থাকলেও তিনি সেটাকে মোকাবিলা করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
এখন আজকের বাংলাদেশ? এখানে কি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ধর্মীয় অনুশাসনকেও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেয়? নারীকে বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে এসে, নাদুস-নুদুস আবরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাইরের জগতের আলো হাওয়ায় মেলে ধরতে সুযোগ বা সাহস দেয়? পরিসংখ্যান সেটাকে সমর্থন করছে না।

উপলব্ধি এটাই বলে তিনি একশও বছর পেছনের হলেও এগিয়ে আছেন আজকের চেয়েও আরও হয়তো একশো বছর। আমাদের সবাইকে আরও বেশি-বেশি করে বেগম রোকেয়াকে সামনে আনতে হবে। আলোচনায় রাখতে হবে তিনি নারীকে কোথায় কোথায় কেমন করে শক্তি ও অধিকার অর্জনের কথা বলে গেছেন। আমরা যদি একটি নারীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, নারীকে তার প্রাপ্য অধিকারের জায়গায় দেখতে চাই তাহলে রোকেয়াকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn