দুই দশক যুদ্ধ শেষে কাবুল ছাড়লেন মার্কিন সেনারা-সেনাদের নিয়ে আফগানিস্তান  ছেড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সামরিক বিমান। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০ বছর ধরে চলা আফগান যুদ্ধের। মার্কিন সেনারা আকাশে উড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী কাবুলসহ সারা দেশে উল্লাস প্রকাশ করেছে তালেবানরা। রাতের আকাশে তারা ফাঁকা গুলি, আতশবাজি ছুড়ে সেলিব্রেট করেছে নিজেদের জয়। তারা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সি-১৭ বিমান ত্যাগ করে। এ তথ্য দিয়েছেন ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি। তবে এখনো যারা কাবুল ত্যাগ করতে পারেননি, তাদের জন্য কূটনৈতিক মিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বিবিসি লিখেছে, সর্বশেষ বিমানটি কাবুল ত্যাগ করার পর কাবুলে তালেবানদের বিজয়সূচক গুলির আওয়াজ শোনা  গেছে। রাতের কাবুলে রাস্তায় রাস্তায় বন্দুক হাতে উল্লাস করতে দেখা যায় তালেবান সদস্যদের। এই বিমানটির কাবুল ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ এবং তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ব্যাপক উদ্ধার অভিযানের অবসান হলো। গত ১৫ই আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবানরা। তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি একজন সেনাসদস্য বা অন্য কেউ। এ  যেন স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ ছিল। সে সময় থেকেই মূলত কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার কার্যক্রম চলছিল।

জেনারেল ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এবং জোট বাহিনীর বিমানগুলোতে করে সব মিলিয়ে এক লাখ ২৩ হাজার বেসামরিক ব্যক্তিকে সরিয়ে আনা হয়েছে। প্রতিদিন সাড়ে সাত হাজারের বেশি বাসিন্দা কাবুল ছাড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই  ঘোষণা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ওয়াশিংটনে বলেছেন, এটি ছিল ‘ব্যাপক সামরিক, কূটনৈতিক এবং মানবিক কর্মযজ্ঞ এবং যা যুক্তরাষ্ট্র অনেক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। সামরিক মিশন সমাপ্ত হয়ে নতুন এক কূটনৈতিক মিশন শুরু হলো।

তবে তিনি এও বলেছেন যে, তালেবানকে বৈধতা অর্জন করতে হবে। সেই সঙ্গে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে কিনা এবং নাগরিকদের ভ্রমণে স্বাধীনতা দেয়া, নারীদের অধিকার রক্ষা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দমন করছে কিনা-এসব বিষয় বিশ্ববাসীর নজরে থাকবে। তিনি জানিয়েছেন, কাবুলে কূটনৈতিক মিশন স্থগিত করে কাতারের রাজধানী দোহা’য় নিয়ে যাওয়া হলেও, আমেরিকান নাগরিক এবং যে আফগানদের যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট রয়েছে, তারা চাইলে তাদের আফগানিস্তান ছাড়তে সহায়তা করবে।

গত ১৭ দিন ধরে চলা এই উদ্ধার অভিযানে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারেন। ২০০১ সালের সাতই অক্টোবর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র  নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী। কারণ তখন দেশটিতে ক্ষমতায় থাকা তালেবান নেতারা আল-কায়েদার ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি।  সেই বছর নভেম্বরে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় মার্কিন  জোট সমর্থিত তালেবান বিরোধী বাহিনী নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।

যুক্তরাষ্ট্রের আফগান ত্যাগ ‘অন্য আগ্রাসীদের জন্য শিক্ষা’-তালেবান
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আফগানিস্তান ত্যাগ করাকে ‘অন্য আগ্রাসীদের জন্য শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করেছে তালেবানরা। তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, এই বিজয় আমাদের সবার। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সামরিক বিমান আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর মঙ্গলবার নিজেদের বিজয়কে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে উদ্‌যাপন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দুই দশক পরে তারা আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে এলো। রাতেই বিমানবন্দরে ছুটে যান তালেবান যোদ্ধারা। কাবুলের পুরো শহরে তারা আকাশে গুলি ছুড়ে বিজয় উদ্‌যাপন করেছেন। মঙ্গলবার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ। এ সময় তিনি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাকে অন্য আগ্রাসীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় বলে মন্তব্য করেন। এতে আরও বলা হয়েছে, আফগানিস্তান বিদেশি সেনামুক্ত হলেও নাগরিকরা তালেবানদের ভয়ে ভীত। কিন্তু বার বার তালেবানরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা আগের তালেবান নেই। তারা হবে অধিক সহনশীল। সরকার হবে সবার অংশগ্রহণে। মুজাহিদ বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। তাদের সবার সঙ্গে আমরা সুস্থ কূটনৈতিক সম্পর্ককে স্বাগত জানাই। তিনি আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- তালেবান নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হবেন ভদ্র ও শান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০ বছরের যুদ্ধের ইতি টানার জন্য ৩১শে আগস্টকে সর্বশেষ সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এ সময়ের মধ্যে সব মার্কিন ও মিত্রবাহিনীকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত দেন তিনি। জি-৭সহ বিভিন্ন নেতারা এই সময়সীমা বৃদ্ধির আহ্বান জানালেও বাইডেন তাতে রাজি হননি। রাজি হয়নি তালেবানরাও। ওদিকে ২০ বছরের এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক লাখ আফগান। মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ২৪০০ সদস্য। এমন প্রেক্ষাপটে ডেডলাইন শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র তার সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর কারণও আছে। কাবুল বিমানবন্দরে তালেবানদের প্রতিপক্ষ ইসলামিক স্টেট (আইএস-কে) হামলা চালাতে পারে বলে হুমকি ছিল। তার প্রেক্ষিতেই আগেভাগে সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরের বাইরে আইএস-কে’র আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৪ মার্কিন সেনা সহ কমপক্ষে ২০০ জন নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধ শেষ: পক্ষে-বিপক্ষে কংগ্রেস সদস্যরা
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রগতিশীল কংগ্রেস সদস্যরা সেনা প্রত্যাহারের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। অন্যদিকে বিরোধী রিপাবলিকান সদস্যরা সেনা প্রত্যাহারের কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেছেন। ডেমোক্রেট দলীয় কংগ্রেসম্যান মার্ক পোকান টুইটারে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ অবশেষে শেষ হলো। আসুন এই ২০ বছরে আমরা যে হাজার হাজার প্রাণ হারিয়েছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিরতি দেই। আসুন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যুদ্ধ বন্ধের। আর কখনো যুদ্ধ নয়। রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতা এবং আফগান যুদ্ধের একজন যোদ্ধা ড্যান ক্রিনশ ওয়াশিংটনের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তালেবানদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসমর্পণ করার জন্য প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের এক সমাবেশে সোমবার তিনি বলেছেন, তারা (ডেমোক্রেট) এই স্লোগানকে ভালোবাসে- আর কোনো সীমাহীন যুদ্ধ নয়। আমরা আবেগের স্লোগানের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছি। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে অধিক থেকে অধিক অনিরাপদ করে তুলেছে।

আফগান পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠ নজরদারি করছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সামরিক বিমান আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর সেখানকার পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠ নজরদারি করছে বেইজিং। অনলাইন আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পাকিস্তানে বড় রকমের বিনিয়োগ, এমনকি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে আফগানিস্তানের পারিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠ নজরদারি করছে চীন। বেইজিং থেকে সাংবাদিক ক্যাট্রিনা ইউ বলেছেন, একদিকে চীন হস্তক্ষেপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে না, অন্যদিকে তারা এখনো পরিস্থিতির ওপর নিবিড় দৃষ্টি রাখছে। বেইজিং চাইছে পরিবর্তিত তালেবানদের একটা সুযোগ দিতে। এ সময়ে তারা কতোটা উদার সে পরীক্ষা দিতে হবে তাদেরকে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn