গ্রিসের লিসবস বা অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা কিংবা বাংলাদেশের কুতুপালং—সবখানে শরণার্থী, সবখানে মাসুম। দেশহারা মানুষের কান্নায় তাঁর বুক ভেসে যায়। মাসুম গেছেন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হাইতি আর নেপালেও। খরাপীড়িত পূর্ব আফ্রিকার ডাকও তিনি শুনেছিলেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে প্রভাবশালী ১০০ বাংলাদেশির তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। তাঁরই বন্ধু শামস শামীম বলছেন আরো অনেক কথা

মাসুমের এক হাতে ক্যামেরা আরেক হাতে থাকে কলম। প্রিন্ট মিডিয়ায় যেমন, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও খবর সরবরাহ করেন। তিনি গিয়েছিলেন মেসিডোনিয়ায়। সিরিয়ান শরণার্থী আমালের গল্প শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন। ইথিওপিয়া আর কেনিয়ায় খরাপীড়িত নারী-পুরুষের হাহাকার শুনেছেন মাসুম। কঙ্কালসার শিশুদের বুকভাঙা কান্না তিনি ভুলতে পারেন না। ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি নিয়েই ১৯ দিন নেপালে ছিলেন। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরের ছবি তুলেছেন ২৫ দিন। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি দেশে তিনি মানুষের কান্না শুনেছেন।

মাসুমের কথা

মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক আবু সালেহ মো. মাসুম। ব্রিটেনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান আল খায়ের ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীন ইকরা বাংলা টিভির সাংবাদিক তিনি। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজটোয়েন্টিফোরের তিনি ইউকে প্রতিনিধি। তবে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে সুনামগঞ্জে।

সিরীয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে

২০১৫ আর ২০১৬। সিরিয়ার শরণার্থীদের মিছিল ছিল ইউরোপে। গবেষকরা বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। সে সময় তিনি সিরীয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। বলেছেন, অন্ততপক্ষে ১১টি দেশে গিয়েছিলাম শরণার্থীদের খবর নিতে। মানুষের কষ্টের কথা শুনে কান্না চেপে রাখতে পারতাম না। বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের পত্রিকা এবং টেলিভিশনে আমি সরেজমিন প্রতিবেদন তুলে ধরতাম। সেসব প্রচার হওয়ার পর অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আল খায়ের ফাউন্ডেশন সেগুলো শরণার্থী শিবিরগুলোতে পৌঁছে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের দুর্যোগের দিনগুলোতে

২০১৬ সালের মে মাসের ২২ তারিখে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানো আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল সেবার। পরদিনই মাসুম হাজির হয়ে গিয়েছিলেন কক্সবাজার। তারপর যান কুতুবদিয়ায়। আল খায়ের ফাউন্ডেশন চেয়েছিল কুতুবদিয়ার দুর্গতদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতে। তহবিল জোগাড়ের নিমিত্তে তথ্যচিত্র নির্মাণে হাত দিলেন মাসুম। সেটি প্রচারের পর সহায়তা মিলল। আল খায়ের কুতুবদিয়ায় কয়েক শ ঘর বানিয়ে দিয়েছে দুর্গতদের। হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার পরও দেশে চলে এসেছিলেন মাসুম। বেশ কয়েকটি ফিচার স্টোরি তৈরি করেন তিনি।

হাইতিতে হারিকেন

উত্তর আমেরিকার দেশ হাইতি। ২০১০ সালে সেখানে মারা যায় তিন লাখ মানুষ প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড়ে। সে দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২০১৬ সালে আঘাত হানে হারিকেন ম্যাথিউ। আল খায়ের ফাউন্ডেশন মাসুমকে পাঠায় হাইতিতে। অচিন এক দেশ। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়নি মাসুমের। ঝড়পীড়িত হাইতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন মাসুম। প্রচার হওয়ার পর সহায়তা তহবিল তৈরি হয়। সাহায্য পায় হাইতি।

পূর্ব আফ্রিকায় দুর্ভিক্ষ

দক্ষিণ সুদান, সোমালিল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার ১৬ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত। মরুর মানুষগুলোর পেশা বলতে পশু পালন। গেল কয়েক বছর সেখানে বৃষ্টি হয়নি। অনাবৃষ্টির কারণে খরার সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে হয় দুর্ভিক্ষ। এ পর্যন্ত সেখানে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। গবাদিপশু মারা গেছে লাখ লাখ। মাসুম ওই দেশগুলোতে ছিলেন ছয় মাসের বেশি। তিনি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। একটি মেডিক্যাল ক্যাম্পও পরিচালনা করেছেন। অপুষ্টির শিকার কয়েক হাজার শিশু এখান থেকে চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছে। এ ছাড়া  আল খায়ের ওয়াটার ট্যাংক দিয়ে প্রতিদিন  ১৫ হাজার পরিবারের মধ্যে পানি বণ্টন করেছেন।

রোহিঙ্গাদের পাশে

গেল ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। মাসুম বাংলাদেশে এসে সোজা চলে যান কক্সবাজার। নৌকা দিয়ে আসতে থাকা রোহিঙ্গা শিশু ও বৃদ্ধদের কাঁধে করে তীরে পৌঁছাতে থাকেন। আল খায়ের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের মধ্যে ঘর তৈরির সরঞ্জাম, পোশাক আর খাবার বিতরণ করেন।

আমালের ঘটনাটি

ডিসেম্বর মাস ছিল সেটা। মেসিডোনিয়া-সার্বিয়া সীমান্তে তখন মাইনাস ৪ ডিগ্রি। সিরিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষগুলো শীতে জবুথবু। মাসুম দলের অন্যদের নিয়ে শীতার্ত  মানুষগুলোর জন্য স্যুপ, রুটি, ফলমূল আর গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে এক গর্ভবতী নারীকে দেখলেন শীতে কাঁপছে। পাশে তাঁর আরো দুটি বাচ্চা ছিল। তারা ক্ষুধায়ও কাতর ছিল। মহিলা অল্পস্বল্প ইংরেজিও জানেন। জানালেন, তাঁর স্বামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর নিজে দন্ত চিকিৎসক। নাম আমাল। বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে সাগরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তিনি তুরস্ক থেকে ডিঙ্গি নৌকায় করে গ্রিসে এসেছেন। তারপর টানা ছয় দিন হেঁটে মেসিডোনিয়া-সার্বিয়া সীমান্তে।

তকমা পেলেন

গেল ২৮ মার্চ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশন (বিবিপিআই) ১০০ প্রভাবশালী ব্রিটিশ-বাংলাদেশির তালিকা প্রকাশ করেছে। মাসুম তাঁদের একজন হয়েছেন। বিবিপিআইয়ের প্রকাশনায় মাসুম সম্পর্কে বলা হয়েছে,  ৪০টিরও বেশি দেশে কাজ করেছেন মাসুম। খবর সংগ্রহ ও তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি দুর্গত মানুষের কাছে মানবিক সাহায্যও পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn