সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। নেতাজি নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। সুভাষ চন্দ্র পরপর দুই বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করায় পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস করতেন, গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। তার বিখ্যাত উক্তি ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবে।’ ব্রিটিশ সরকারের হাতে ১১ বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়ার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সুভাষ বসু। চিকিত্সার জন্য ব্রিটিশ সরকারের থেকে ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার পর তিনি অস্ট্রিয়া যান। ভিয়েনায় চিকিত্সা করানোর সময় সুভাষ চন্দ্র ঠিক করেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে ইউরোপে  বসবাসরত ভারতীয় ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করা দরকার। ঐ সময়ে এক ইউরোপীয় প্রকাশক তাকে ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নামের একটা বই লেখার কাজ দেন। বইটি লেখার জন্য সুভাষ চন্দ্রের একজন সহকারীর প্রয়োজন ছিল, যিনি ইংরেজি আর টাইপিং – দুটি বিষয়েই দক্ষ। সেই সূত্রে তার কাছে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন এক অস্ট্রিয়ান তরুণী। নাম তার এমিলি শেঙ্কল। সহকর্মী হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করা এই এমিলির এক সময় গড়ে ওঠে সখ্য যা গড়ায় বিয়ে পর্যন্ত। সেটা ১৯৩৪ সালের জুন মাস। সুভাষ চন্দ্রের বয়স ৩৭ বছর। তার ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল কী করে ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতকে স্বাধীন করা যায়।সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরত্ বসুর নাতি ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসু নিজের বই ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট- সুভাষ চন্দ্র বসু এন্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার’-এ লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। এমিলির সৌন্দর্য সুভাষের ওপরে যেন কী একটা জাদু করেছিল।
এমিলিকে উদ্ধৃত করে সুগত বসু তার বইতে লিখেছেন, ‘প্রেমের আভাসটা সুভাষ চন্দ্র বসুর দিক থেকেই এসেছিল। ধীরে ধীরে সেটা একটা রোমান্টিক সম্পর্কের দিকে মোড় নেয়। ১৯৩৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছর দুয়েক অস্ট্রিয়া আর চেকস্লাভাকিয়াতে থাকার সময়ে তাদের সেই সম্পর্কটা আরো মধুর হয়ে উঠেছিল।’ সেই পরিস্থিতিতেও সুভাষ চন্দ্র এমিলির জন্য কতটা চিন্তা করতেন, তার প্রমাণ মিলেছে এমিলিকে লেখা সুভাষ বসুর একটি চিঠিতে। এমিলি নিজেই এই চিঠিটা তুলে দিয়েছিলেন শরত্ চন্দ্র বসুর ছেলে, ডা. শিশির বসুর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুর হাতে। চিঠিটা ছিল এমন ‘মাই ডার্লিং, কখনও সখনও হিমবাহও গলে যায়। আমার মনে এখন অনেকটা সেরকমই অবস্থা। আমি যে তোমায় কতটা ভালোবাসি সেটা জানাতে এই চিঠিটা লেখা থেকে নিজেকে সম্বরণ করতে পারলাম না। ‘মাই ডার্লিং’, আমাদের নিজেদের মতো করে কী বলতে পারি, যে তুমি আমার হূদয়ের রানি?’ ঐ চিঠিতে তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়ত জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করে দেয়া হতে পারে, কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়ত আমাকে কখনো আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনও তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না। কিন্তু ভরসা রেখ, তুমি চিরকাল আমার হূদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।’

ড. কৃষ্ণা বসুকে এমিলি বলেছিলেন, ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল তাদের পছন্দের রিসোর্ট অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিজের বিয়ের তারিখটা ছাড়া আর কোনো কিছু্ই বলতে চাননি এমিলি। সুভাষ চন্দ্র আর এমিলির মেয়ে অনিতা বসু তার মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছেন তার ভিত্তিতেই বলেছিলেন, ভারতীয় নববধূর মতো বিয়ের সময়ে মাথায় সিঁদুর পরানো হয়েছিল এমিলি শেঙ্কলের সিঁথিতে।-বিবিসি

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn