রাফসান জানি–  কয়েক দিনের ব্যবধানে ঢাকার সাভার ও ঝালকাঠিতে দুজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুজনই ধর্ষণ মামলার আসামি। তাদের লাশের সঙ্গে পাওয়া গেছে ‘ধর্ষক’ পরিচয়ের চিরকুট। ঘটনা দুটি পৃথক হলেও কয়েকটি বিষয়ে মিল রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে এবং লাশের সঙ্গে চিরকুট ঝুলিয়ে দিচ্ছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কাউকে এখনও চিহ্নিত বা গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। ফলে কে বা কারা হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে এবং কেন চিরকুট ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারও প্রকৃত কারণ বলতে পারেননি সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বশীলরা। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ ও জড়িতদের খুঁজে বের করা না হলে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে। তারা বলছেন, যেকোনও অপরাধের জন্য রাষ্ট্রে আইন রয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডই ‘অস্বাভাবিক’ এবং অনেকটা একই ধরনের। একে ‘রহস্যজনক’ অভিহিত করে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
গত ১৭ জানুয়ারি সাভারের খাগান এলাকার আমিন মডেল টাউনের একটি মাঠ থেকে এক নারী পোশাকশ্রমিকের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি রিপনের (৩৯) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর ৯ দিন পর ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে পাশের জেলা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামি ছিল। সাভারে নিহত রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি ধর্ষণ মামলার মূল হোতা।’ অপরদিকে ঝালকাঠিতে নিহত সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি মিতার (ছদ্মনাম) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’ নিহত রিপনের স্ত্রী রিক্তা জানান, গত ১১ জানুয়ারি আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় তাদের ভাড়া বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তার স্বামী রিপনকে কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজের ৫ দিন পর সাভারের খাগান এলাকার আমিন মডেল টাউনের ভেতরে একটি মাঠ থেকে তার লাশ উদ্ধারের খবর পান।
তবে তুলে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সাভার এলাকার ডিবি (উত্তর) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সাঈদ। তিনি বলেন, ‘আমার এ বিষয়টি জানা নেই। আমাদের কেউ তুলে আনেনি। এছাড়া এ ধর্ষণ মামলার তদন্তও আমরা করছি না।’ হত্যাকাণ্ডটি কে বা কারা ঘটিয়েছে তা এখনও জানা যায়নি বলেছেন সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আওয়াল।  রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানা গেছে, আশুলিয়ায় ধর্ষণের ঘটনায় গত ৭ জানুয়ারি মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কারখানা ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে ওই নারীর গতিরোধ করে স্থানীয় রহিম, শিপন ও কারখানার লাইনচিফ রিপনসহ পাঁচ বখাটে। এরপর তারা ওই নারীকে ধর্ষণ করে। এর এক দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারী মারা যান। ঝালকাঠিতে নিহত সজলের পরিবার জানিয়েছে, ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সজল ঢাকায় পালিয়ে আসে। মধ্যবাড্ডায় শ্বশুরের বাসায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তাকে ডেকে নেওয়ার পর নিখোঁজ হয় এবং পরে ঝালকাঠিতে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।
সজলের চাচা লাবলু জমাদ্দার জানিয়েছেন, ঘটনার পরপর সজল ঢাকায় চলে যায়। ১৫ জানুয়ারি তাকে রাকিব নামে একজন শ্বশুরের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর আর তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।  সজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানা গেছে, গত ১২ জানুয়ারি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনার শিকার মেয়েটির পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, নিজ বাড়ি থেকে নানাবাড়ি যাওয়ার পথে ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ অভিযোগে সজলকে প্রধান আসামি করে গত ১৪ জানুয়ারি ভান্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়। মামলা হওয়ার পর সজল গা-ঢাকা দেয়।
মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘দুটি মৃত্যুই অস্বাভাবিক। দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলো ও তাদের মৃতদেহ পাওয়া গেলো। দুটো মৃত্যুর মধ্যে মিলও পাওয়া গেছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে, তদন্ত করে বের করা ঘটনাটি কীভাবে ঘঠেছে এবং কারা ঘঠিয়েছে। এটা একটা অপরাধমূলক ঘটনা।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনও অপরাধমূলক ঘটনার সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা তুলে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তারা যদি প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের না করেন এবং ঘটনার সংখ্যা যদি বাড়তেই থাকে তাহলে জনমনে অনেক ধরনের সন্দেহ দেখা দিতে পারে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn