বিন্দু তালুকদার-
শাল্লা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার দীন মোহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ১ম সাময়িক পরীক্ষার জন্য প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র সরবরাহ দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উপরে শাল্লা, কিশোরগঞ্জ লেখা দেখতে পাওয়া গেছে।  উপজেলা শিক্ষা অফিস ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ মে থেকে শাল্লা উপজেলার ১০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম সাময়িক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র গত ৫ ও ৬ মে উপজেলা শিক্ষা অফিস প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়। নতুন পরিপত্রের দোহাই দিয়ে প্রশ্নপত্র বাবদ শ্রেণী অনুসারে প্রতিসেট প্রশ্ন ১ম শ্রেণী ৪ টাকা, ২য় শ্রেণী ৬ টাকা, ৩য় শ্রেণী ৭ টাকা, ৪র্থ শ্রেণী ৮ টাকা এবং ৫ম শ্রেণী ১০ টাকা হারে আদায় করা হয়েছে।
১ম শ্রেণীতে ৩৪০৪জন, ২য় শ্রেণীতে ৩১৯৩ জন, ৩য় শ্রেণীতে ২৪৫০ জন, ৪র্থ শ্রেণীতে ২০০৯ জন, ৫ম শ্রেণীতে ১৫৪৫ জনসহ মোট ১২,৬০১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৮১,৪৪৬ টাকা উত্তোলন করা হয়। গত বছরগুলোর পরীক্ষার সময় প্রতিটি শ্রেণীর প্রতিসেট প্রশ্নপত্র ৩ টাকা হারে নেওয়া হতো, এবং শিক্ষার্থীদের হতে ফিস নেওয়া হতো ১ম শ্রেণী ৫ টাকা, ২য় শ্রেণী ১০ টাকা, ৩য় শ্রেণী ১৫ টাকা, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণী ২০ টাকা। কিন্তু এ বছর ১ম শ্রেণী ১০ টাকা, ২য় শ্রেণী ১৫ টাকা, ৩য় শ্রেণী ২৫ টাকা, ৪র্থ শ্রেণী ৩০ টাকা ও ৫ম শ্রেণী ৩৫ টাকা করে ফিস নেওয়া হচ্ছে।
জানা  যায়, ১ম সাময়িক পরীক্ষা ২০১৭ এর প্রশ্নপত্র ছাপানো বাবদ খরচ ১ম থেকে ৫ম শ্রেণীর জন্য শিক্ষার্থী প্রতি সেট ১.৫০ টাকা হারে ১৮,৯০০ টাকা, প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রশ্ন বহনের জন্য খরচ প্রতি ব্যাগ ৫ টাকা করে ৫৩৫ টাকা এবং কিশোরগঞ্জ থেকে প্রশ্ন শাল্লায় আনতে পরিবহন খরচ আনুমানিক ২,০০০ টাকাসহ মোট খরচ ২১,৪৩৫ টাকা। উত্তোলিত অর্থ ৮১,৪৪৬ টাকা হতে খরচ বাদে মোট ৬০,০০০ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে রেখেছেন শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার দীন মোহাম্মদ। তবে এ অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন তিনি।  খোঁজ নিয়ে জানা যায় শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রশ্ন প্রিন্টিং করেন কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের আখড়া বাজারের ‘রাব্বী অফসেট প্রিন্টিং প্রেস’ থেকে।  ওই প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন,‘ দীন মোহাম্মদ স্যার আগে যে রেইটে প্রশ্নপত্র নিতেন এ বছরও সেই রেইটেই নিয়েছেন। রেইটটা কত ? জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন- প্রতিসেট (১ম-৫ম শ্রেণীর জন্য একই রেইট) প্রশ্নের জন্য ১.৫০ টাকা করে।
তবে শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার দীন মোহাম্মদ নতুন প্রজ্ঞাপন জারির দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছেন।  অথচ পরিপত্রের ৩ এর ক-তে উল্লেখ আছে, সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা পরিচালনার নিমিত্ত পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি গঠন ও কার্যপরিধি নির্ধারণ এবং পরীক্ষা ফিস পুনঃ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এই কমিটি হবে, উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে সভাপতি, সকল সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার সদস্য। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হবেন সদস্য সচিব। সদস্য হিসাবে ১ জন শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক, ২ জন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক (১জন পুরুষ ও ১জন মহিলা) কমিটিতে থাকবেন।  কমিটি সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণের মাধ্যমে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষক দ্বারা বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সংগ্রহ করবেন। সংগৃহীত এসকল প্রশ্নপত্র পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি নিজ উদ্যোগে মডারেশন (যাচাই-বাছাই) করে সমগ্র উপজেলার জন্য প্রতিটি বিষয়ের মানসম্মত প্রশ্নপত্র তৈরী করবেন।
পরিপত্রের ৩ (খ) এর ৮ ও ১০নং এ উল্লেখ আছে সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার জন্য আহরিত অর্থ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অর্থ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের যৌথ স্বাক্ষরে সিডিউল ব্যাংকে হিসাব খুলে জমা রাখতে হবে এবং এই অর্থ থেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের পুরস্কার সহ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।  প্রশ্নপত্রের বিষয়ে একাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন,‘পরিপত্রের যে অংশটুকুতে শুধু ফিসের পরিমাণ দেওয়া আছে সেই অংশটুকুই অফিসের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার কথা থাকলেও উনি তা না করে উনার বাড়ির পাশের জেলা কিশোরগঞ্জ থেকে প্রশ্ন ছাপান। যার ফলশ্রুতিতে প্রশ্নের উপরে শাল্লা, কিশোরগঞ্জ লেখাও রয়েছে।’ ওই প্রধান শিক্ষকদের অভিমত, যেহেতু কাগজ, কলম ও কালির দাম আগের মতই অপরিবর্তিত আছে সেহেতু শুধুমাত্র শিক্ষা অফিসার অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য নতুন পরিপত্রের দোহাই দিয়ে পরীক্ষার ফি বৃদ্ধি করেছেন। আমরা কোন মতেই এই বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না।
পরীক্ষার ফিস বাড়ানোর প্রসঙ্গে শাল্লার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরকে বলেন,‘ সরকার কাগজ কলম ও কালির দাম বাড়ায়নি। কিন্তু কি অজুহাতে পরীক্ষার ফিস বাড়ানো হলো, তা আমরা জানি না। পরীক্ষা না দিলে উপবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে সেই ভয়ে অতিরিক্ত ফিস দিয়েছি। আমাদের ফসল নিল পাইন্নে, হাওরের মাছ মরল পচা ধানের গন্ধে, আমরা কিভাবে বাচুম তাই ভেবে কুল-কিনারা পাই না, এখন আবার পরীক্ষার অতিরিক্ত ফিস দিতে হচ্ছে,“এ যে মরার উপর খরার ঘা”।
শাল্লা উপজেলা সরকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি রমেন্দ্র নারায়ন দাস বলেন,‘ টিও স্যার জানিয়েছেন নতুন পরিপত্র অনুযায়ী পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ক্রয় ও খরচের পর কোন টাকা উদ্বৃত্ত আছে কিনা তা আমার জানা নেই। টিও স্যার জানিয়েছেন একটা কমিটি আছেন, সেই কমিটির সদস্য আছেন ঘুঙ্গিয়ারগাঁও মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরঞ্জিত চৌধুরী। ’
এ ব্যাপারে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরঞ্জিত চৌধুরী বলেন, ‘গত ১১ মে আমাকে জানানো হয়েছে যে আমি কমিটির সদস্য। আমি প্রশ্নপত্র বিষয়ে কিছুই জানি না। ব্যাংক একাউন্ট আছে কিনা সেটিও আমার জানা নেই।’হিসাব খোলা ও অর্থ জমার বিষয়ে উপজেলা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মিন্টু সরকার বলেন,‘ আপনি অফিসে এসে তথ্য জেনে যান। আমি এখন স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারব না। অফিস খোলার দিন বা কয়েক দিন পর ফোন করলে তা বলতে পারব। ’
উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) দীন মোহাম্মদ বলেন,‘ পরীক্ষার ফি শুধু শাল্লায় নয় নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে সারা দেশেই বাড়ানো হয়েছে। আমি ইচ্ছে করেই কোন ফি বাড়াইনি। সব প্রশ্নপত্রই কিশোরগঞ্জ থেকে ছাপানো হয়েছে। ভুল করে একটি সেটে কিশোরগঞ্জ লেখা রয়েছে। পরীক্ষা চলছে এখন শেষ হয়নি। শেষ হওয়ার পর একটি মিটিং ও খরচের হিসাব হবে। পুরাতন ব্যাংক একাউন্ট খোলা আছে। উদ্বৃত্ত টাকা উপজেলা কমিটির সেই ব্যাংক একাউন্টে জমা হবে। কত টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে তা এখনই বলা যাবে না। যারা বলছে ৬০ হাজার রয়েছে তারা কিভাবে বলছে আমি জানি না। আমার জানাও নেই।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn