রাশিম মোল্লা : আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশি ঝামেলার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনের নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে আজ বৃহস্পতিবারও বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারী ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) পাঁচ শতাধিক পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে মোতায়েন ছিলো। সকাল ১০টা থেকে দ্বিতীয় দিনের ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১০টা ২০ মিনিটে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ১০টা ১৩ মিনিটে পুলিশের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ব্যালট পেপার নিয়ে ভোট কেন্দ্রে ঢুকেন কমিশনের এক সদস্য। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান মনির বলেন, ১০টা ২০ মিনিটে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বিকাল ৫টায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়। তবে সাংবাদি কদের ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। এ প্রতিবেদক ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে -যাওয়া যাবে না, বলে বাধা দেন সাদা দলের কয়েকজন আইনজীবী। পরে কমিশনের এক সদস্যকে ফোন দিয়ে অনুমতি চাইলে তিনিও অনুমতি দেননি।

কখন আসবেন অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানানো হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা ভোট দিলেও অবৈধ ভোট ঘোষণা করে বিরত ছিলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের দাবি আগে নতুন নির্বাচন কমিশন পরে ভোট গ্রহণের তারিখের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

হাতাহাতি আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের

সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ফের ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতিতে জড়ান আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এনেক্স ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের একতরফা ভোটগ্রহণ প্রতিহত করতে নির্বাচনী বুথের দিকে যেতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ভোটকেন্দ্রে ঢোকার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেন। প্রবেশপথে প্রতিহতের চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগপন্থি আইনবীজীরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুইপক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করে।

প্রধান বিচারপতির কাছে যা বলেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা

সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন পরিচালনাকে ঘিরে পুলিশের হামলাসহ বুধবার ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগে তুলে ধরেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা ১১টার সময় খাসকামরায় আসেন। প্রয়োজন হলে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডেকে নেব। সকাল নয়টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থি  আইনজীবীরা। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর সাত বিচারপতি। এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, বুধবার আদালত প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা  ঘটেছে, যা আজও চলমান। আমাদের অনেকের রুমে তালা লাগানো আছে, অনেকের রুমের চারপাশে পুলিশ দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কি না, তা দেখতে হবে। এই অঙ্গনে এটা কি অনুমোদিত? তারা সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। আমরা সুরক্ষা চাই। বিএনপি প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার  রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। সমিতির নির্বাচন হয় সব সময় উৎসবমুখর। তবে এবার কী হলো? আজও আমি রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগানো। কক্ষের সামনে পুলিশ রয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক আইনজীবী আহত হয়েছেন। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গতকালের ঘটনা দেখেছেন, পুলিশ কীভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়েছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমি প্রার্থী, আমি কেন ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারব না? বেশ কয়েকটি পত্রিকা আদালতে উপস্থাপন করে রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আপনারা এ অঙ্গনের অভিভাবক। আপনারা দেখেন। বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরীকে প্রধান করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয়। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় প্রার্থী পরিচিতি সভায় তিনি দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু হঠাৎ কী হলো?  তিনি পদত্যাগ করলেন। তিনি ফোনে আমাকে জানিয়েছেন, বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। তারা আলাদা ব্যালট পেপার তৈরি করে যেভাবে বলবে, সেভাবে কাজ করতে বলেছে। তাই উনি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পর এখন সর্বসম্মতিক্রমে নতুন পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে। তবে তা না করেই তারা ভোট গ্রহণ শুরু করেছে। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ঘায়েল করতে মামলা করা হয়েছে।

রুহুল কুদ্দুস কাজল  বলেন, বুধবার  রাতে মো. মনিরুজ্জামান (নির্বাচন উপকমিটির আহ্বায়ক) সাহেব বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। আমাকে ও সভাপতি প্রার্থীসহ শতাধিক নেতা কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় আরেকটি মামলা করেছে সমিতির প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দিয়ে। সেখানে সমিতির বর্তমান কমিটির ছয়জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন,  আপনাদের সবাইকে সম্মান করি। আপনারা ২ জন ১১টার সময়  আসেন। কোনো করণীয় থাকলে করব। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডেকে নেব। সমিতির সভাপতি পদপ্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটকেন্দ্রে ৩০০ থেকে ৪০০ পুলিশ ঢুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সবাই পড়ে যাচ্ছিল আর পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়েছে। আমার পায়ে ব্যথা। আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। অনেক আইনজীবী ও সাংবাদিককে আহত করা হয়েছে। একপর্যায়ে রুমের তালা খুলে দেওয়ার ও পুলিশ সরানোর আরজি জানান রুহুল কুদ্দুস। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, কোর্টে বসে এটি বললে আদেশ হয়ে যাবে। ১১টায় আসেন, শুনি।

বারের নির্বাচন প্রসঙ্গে আইনজ্ঞরা যা বললেন

সুপ্রিমকোর্ট বার নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের হট্টগোল ও পুলিশের হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে তারা মনে করেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশে যে গণতন্ত্রের অভাব এর প্রতিফলন হলো সুপ্রিম কোর্টে সাম্প্রতিককালের নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্ট বারের গত দুই নির্বাচন দেখে মনে হচ্ছে, বারের নির্বাচনের জন্য দুই-তিন সপ্তাহের জন্য একটা তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনী ব্যবস্থা দরকার। বিদ্যমান অবস্থায় আর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, বিগত দিনে বারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল বলে মনে হয় না। সব সময় সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচন হয়েছে। এখন দেশে গণতন্ত্রহীনতার প্রভাব বিরাজ করছে। সুপ্রিমকোর্টও সেই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এটা এখন স্পষ্ট।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আইনজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি সংগঠন। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশের বড় বড় আইনজীবী। তখন দলমত নির্বিশেষে সুপ্রিম কোর্ট বারের বিষয়ে সবাই এক ছিলেন। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দুই বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট বারে অনৈক্য দেখছি। যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন। শফিক আহমেদ বলেন, আইনজীবীদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।আইনজীবীরা যদি গোলমাল, মারামারি করে তাহলে আর থাকে কী? এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। এখন যারা সিনিয়র আছেন তারা বসে এর সমাধান করবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn