অহী আলম রেজা :: ১৯৯৮ সাল। ফুটবল বিশ্বকাপের ধামামা বাজছে। চারদিকে হৈ চৈ। দর্শক-সমর্থকরা বিভক্ত। নিজের পছন্দের দলের গুণকীর্তনের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ সমর্থকদের ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। পতাকা উড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছেই। রাস্তাঘাট, গাড়ি, বাড়ির ছাঁদ, গাছের মগডাল- সবখানেই ভিনদেশি পতাকার ছড়াছড়ি।  এ সময় রাজনীতিতেও উত্তাপ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। সিলেটের রাজনীতিতে তখন জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত আলাদা বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসুচি। সভা সমাবেশ হচ্ছে সুনামগঞ্জে। প্রকাশ্যে বিভক্ত নেতাকর্মীরা।  পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ আসলে কালো পতাকা দেখানো হবে। প্রস্তুত সুরঞ্জিত বলয়। ‘লিডার’ এর কানে এ খবর পৌছলেও তিনি জেদ ধরেন সুনামগঞ্জে আসবেন।  গল্পটি তৎকালীন একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে শোনা। পরের সপ্তাহে যথারীতি মন্ত্রিসভা বৈঠক। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আব্দুস সামাদ আজাদকে উদ্দেশ্য করে কৌতুকচ্ছলে বললেন, সুনামগঞ্জে কি শুনি, পতাকা আর পতাকা। এসব কি ? অভিজ্ঞ কূটনৈতিক আব্দুস সামাদ আজাদও সতর্ক। তিনি আস্তে করে বললেন, বিশ্বকাপ একটা আসছে, খালি পতাকা আর পতাকা। ছেলে বুড়ো সবাই পতাকা নিয়ে ব্যস্ত। ততক্ষণে হাস্যরসের সৃষ্টি হয় মন্ত্রিসভা বৈঠকে। এভাবে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। কূটনীতির ভাষা রাজনীতিতে ব্যবহার করতেন।  কঠিন আর কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। যাকে ভালবাসতেন তাকে সব উজাড় করে দিতেন। যার উপর ক্ষুব্ধ হতেন তার ব্যাপারে বলতেন, ‘ছেলেটি বুঝেনি’। অবশ্য পরবর্তীতে ঠিকই বুঝিয়ে দিতেন। নিজ বলয়েরও কাউকে ছাড় দিতেন না। মঞ্চের সামনে থাকলেও দেখতেন না এমনকি নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন না। পরে অবশ্য বলতেন- ‘ও তুমিও দেখছি আছো’। আবার প্রতিপক্ষ কাউকে সভায় না দেখলেও নাম ধরে ডাকতেন। এটা ছিল আব্দুস সামাদ আজাদের নিজস্ব স্টাইল।

আব্দুস সামাদ আজাদ সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলতেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলতেন লিডারের উপর জিনের ‘আছর’ আছে। তবে, কে কোন পথে হাটছে সব খবরই রাখতেন। ঢাকা অবস্থান করলেও সিলেট-সুনামগঞ্জের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করতেন।  তাঁর কলাবাগনের বাসভবনে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক আড্ডায় মেতে ঊঠতেন তিনি। রাতজাগা রাজনীতি নিয়ে তোফায়েল আহমদ একবার বলেছিলেন- রাত যত বাড়ে সামাদ আজাদ তত জাগেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের সময় এক রাতে সামাদ আজাদের উপশহরের বাসায় নেতারা বসেছেন। রাত ১১টায় তার অনুসারীরা বললেন, আমাদের লিডারের রাত মাত্র শুরু। অন্যদের চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, আমরা যারা নতুন তাদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করুন। অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। দেওয়ান ফরিদ গাজী সামাদ আজাদকে দেখিয়ে বললেন, স্কুলের হেডমাস্টার তো আছেনই। স্কুল শুরু করলেই হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজীকে ইঙ্গিত করে সামাদ আজাদ বললেন, উনি মাস্টার হিসেবে জয়েন করলে আমি হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে রাজি। রাজনীতির বটবৃক্ষ আব্দুস সামাদ আজাদের জীবনে যে ভুল ছিলনা তা নয়। যতবার রাজনীতিতে বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছেন ততবার তাঁর অনুগত অনুসারীদের জন্য। তিনি যাদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাদেরে অনেকেই ছিলেন, জনবিচ্ছিন্ন, স্বার্থপর, প্রতিহিংসাপরায়ন।  আজীবন তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো রাজপথ, কখনো জেলজীবন, কখনো আন্ডারগ্রাউন্ড। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn