মো. ওলিউর রহমা-

এক সময় সিলেট আওয়ামী লীগের সুনাম কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নিকট উজ্জ্বল ছিলো। সারাদেশে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মশাল ছিলো সিলেট আওয়ামী লীগ।  বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন, ৬৯’র আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সিলেট আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্বল ভূমিকা সারাদেশে প্রশংসা অর্জন করে। গ্রুপিং-লবিং পূর্বেও ছিলো। কিন্তু আন্দোলন ও ভোটের রাজনীতিতে সবাই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে যেতেন। সেখানে কোন গ্রুপিং-লবিং থাকতো না। কিন্তু দিনে দিনে সিলেট আওয়ামী লীগে প্রধান শক্র এখন নিজ সংগঠনের ভেতর অনৈক্য আর বিশৃঙ্খলা। এখানে বিএনপি-জামায়াত প্রধান বিরোধী থাকে না। আর তার বাস্তব উদাহরণ ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাচনে দলের ভরাডুবির ঘটনা। সিলেট আওয়ামী লীগে স্বাধীনতা উত্তর গ্রুপিংয়ের বিষয় উত্তাপিত হলেই নাম আসতো সামাদ গ্রুপ-গাজী গ্রুপ। এরপর স্পীকার গ্রুপ (হুমায়ুন রশীদ) ও সেন গ্রুপ। এই গ্রুপিং গুলিই ছিলো শক্ত শেকড়ে।

আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র মৃত্যুর পরও দলীয় কোন্দল শেষ হয়ে যায়নি। মূলত নেতাকে ঘিরে জেলা পর্যায়ের কিছু সুবিধাবাদী লোক গ্রুপিং রাজনীতি তৈরি করে তাদের ব্যবসা-বানিজ্যের প্রসার ঘটাতো। আর সিলেটের তৃনমূল আওয়ামী লীগ চিনতো বঙ্গবন্ধু-নৌকাকে। পরবর্তীতে জননেত্রী শেখ হাসিনা-নৌকাকে। দিনে দিনে এ শক্তিশালী তৃনমূল হতাশ হয়ে যাচ্ছে। সুবিধাবাদী নেতাদের রাজনীতি বিজয়ী হচ্ছে। গ্রুপিংয়ের কারণে সিলেটে পথহারা আওয়ামী লীগ, ভাসছে সুবিদাবাদীদের তরী।

এসব বিষয় ছাড়াও কমিটির মেয়াদ অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে কোন সম্মেলন আয়োজন না করায় তৃনমূলে হতাশা বিরাজ করছে। গতকাল মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সিলেটের বিশ্বনাথে তৃণমূল আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিতর্কিত এবং সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে উপজেলা কমিটি গঠনেরও আহবান জানায়।  এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদরাসা মাঠে সিলেট বিভাগীয় তৃণমূল প্রতিনিধি সমাবেশে দলের ভিতর শৃঙ্খলা এবং মতৈক্য ফিরিয়ে তৃণমূলের নেতাদের মূল্যায়ন করে দল শক্তিশালীকরণই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এমনটাই মনে করছেন দলের ত্যাগী নেতারা। সিলেট আওয়ামী লীগে বিশৃঙ্খলার শুরু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে। তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করে বিভিন্নস্থানে নিজ নিজ বলয়ের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ায় দলের ভিতর মতানৈক্য দেখা দেয়। নিজ বলয়ের প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় দলের অনেক শীর্ষ নেতা দলের প্রার্থীর পক্ষে নিশ্চুপ ছিলেন।

আবার মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের অনেক নেতা তৃণমূলের চাপে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন। তবে অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থী নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভও করেন। এর উদাহরণ হিসেবে রয়েছে প্রথম ধাপে ইউনিয়ন নির্বাচন হওয়া সিলেট সদর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন। এখানে মাত্র দু’জন প্রার্থী দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে বিজয়ী হন।  ৩টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয় ছিনিয়ে নেন। সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারায় ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দুটিতে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। অনেক ইউনিয়নে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে না পারায় ভরাডুবিও হয়। এমনভাবে সিলেটের অন্যান্য উপজেলায়ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হন দলীয় প্রার্থীরা।

বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও একাধিক প্রার্থী থাকায় অনেক উপজেলার কর্তৃত্ব হারাতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। সম্প্রতি জেলা পরিষদ নির্বাচনেও সিলেটে একক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থী জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট লূৎফুর রহমানের বিপক্ষে মাঠে নামেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা জিয়া উদ্দিন লালা ও এনামুল হক সরদারের পক্ষে গোপনে কাজ করেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা।  তবে শেষ পর্যন্ত সিলেটে লূৎফুর রহমান বিজয়ী হলেও সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল হুদা মুকুটের কাছে হেরে যান শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন। সেখানে দলীয় কোন্দলের কারণে জেলা সভাপতি মতিউর রহমান বিদ্রোহী প্রার্থী মুকুটের পক্ষে কাজ করেন। সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করলেও দলের হাইকমান্ড তা নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছে। বর্ষিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর শূন্য হওয়া দিরাই-শাল্লা আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সুরঞ্জিত পত্নী ড. জয়া সেন। তার পক্ষেও কাজ করছে না দলের বৃহৎ একটি অংশ। জেলা সভাপতি মতিউর রহমান শেষ মুহূর্তে প্রচারণায় অংশ নিলেও অনেকে বলছেন দলের হাইকমান্ডকে দেখাতে লোক দেখানো প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি।

কারণ জয়া সেনের নির্বাচনী বোর্ডের কোন নেতার সাথে নির্বাচন বিষয়ে তিনি কোন আলোচনা করেননি বলে অভিযোগ তাদের। এমন প্রেক্ষাপটে দীর্ঘকাল ধরে নৌকার পাল উড়ে চলা দিরাই-শাল্লার সংসদীয় আসনটির নিশ্চিত জয়ের প্রত্যাশাকে ডুবিয়ে দেওয়ার কূটকৌশল যাতে বিজয়ী হতে না পারে এর জন্য এখনিই দরকার কেন্দ্রীয় নেতাদের তৎপরতা। এদিকে গত ৬ মার্চ সিলেটের নবগঠিত ওসমানীনগর ও জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দ্ব›দ্ব চরম আকার ধারণ করে। ওসমানীনগরে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হন দু’জন নিরিহ ভোটার। শুধু প্রাণহানীই ঘটে নাই, ওসমানীনগরে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান; এ তিন পদেই ভরাডুবি হয় আওয়ামী লীগের। বিজয়ী হন বিএনপি প্রার্থীরা।

এখানে ২য় অবস্থানে ছিলেন- আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর বিষয়ক সম্পাদক জগলু চৌধুরী। তার পিছনে ছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ অনেকেই। নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থান হয় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আতাউর রহমানের। বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার হন ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা দলের নেতা জগলু চৌধুরী।  এমন পরিণতি দলের ভিতর সমন্নয়হীনতার অভাবে হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। একই পরিস্থিতির জন্য জগন্নাথপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী পরাজিত হন। সেখানেও একক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। মূলত প্রার্থী নির্ধারণে মতানৈক্য, তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজ বলয়ের প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় এমন পরিনতি বরণ করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে, এমনটাই মত আওয়ামী লীগের সিনিয়র অনেক নেতার।

জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা জানান- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শুরুতে এমপি বলয় এবং এন্টি এমপি বলয় তৈরি হলেও এখন বিভিন্ন গ্রুপ এবং উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। আর এর পেছনে আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনগুলো অনেকাংশে দায়ী। এসব সংগঠনের গ্রুপিংয়ের কারণে এর প্রভাব পড়ছে আওয়ামী লীগের ভেতরও।  এক সময় সিলেটে ৪ বলয়ের রাজনীতি আওয়ামী লীগে পরিচালিত হলেও এখন বেড়েছে একাধিক বলয়। যে কারণে প্রতিযোগিতার বদলে বেড়েছে প্রতিহিংসার মাত্রাও। বহুবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগ, এর কারণ মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের গ্রুপিং। আধিপত্য বিস্তারের নামে প্রাণ গেছে অনেক কর্মীর। বিভিন্ন উপজেলায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কোন সম্মেলন হয়নি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের।

সম্প্রতি সিলেটের কয়েকটি উপজেলায় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সম্মেলন আয়োজন করলেও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে কোথাও কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না। যোগ্য-অযোগ্য বিবেচনায় না নিয়ে নিজ নিজ বলয়ের কর্মীদের কমিটিতে নিয়ে আসতে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনড় অবস্থানের কারণে সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বেকায়দায় পড়েছেন। চাপ সামলে কমিটি ঘোষণা করতে পারছেন না তারা।

আওয়ামী রাজনীতির প্রাণ শক্তি ছাত্রলীগ। একাধিকবার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েও সম্মেলন আয়োজন করতে পারছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। যা হাস্যকর অবস্থায় চলে যাচ্ছে। অতীতে কখনো এতো নড়বড়ে অবস্থা হয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা গেছে- কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন সিলেটের সন্তান হওয়ায় তার ওপর সিলেটের বলয় কেন্দ্রীক শীর্ষ নেতারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। যে কারণে তিনি অনেকটা চাপের মধ্যে রয়েছেন। তৃণমূলের অনেক নেতা জানান- আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে শহর থেকে গ্রাম, অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় সর্বত্র উন্নয়ন লক্ষমাত্রা আকাশচুম্বি হলেও এসবের প্রচারণায় বিমুখ রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।  অধিকাংশ ভোটার গ্রামে বসবাস করলেও তাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের। দলীয় নেত্রী প্রত্যেকটি জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করে দিলেও প্রার্থীরা এ প্রচারণা থেকে পিছিয়ে আছেন। এখনো অনেক প্রার্থী হিসাব-নিকাশ করছেন বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে আসবে কী না।

মাঠের এবং ভোটের রাজনীতিতে মনোযোগী না হলেও সুবিধাভোগীরা সুবিধা লুঠার কাজেই ব্যস্ত। সকাল থেকে রাত নেতার পিছে ঘুরে সুবিধা আদায়ে তৎপর অধিকাংশ নেতাকর্মী। সাধারণ ভোটারদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ না করে অযাচিত লেখালেখি-পোস্টার ছাপিয়ে যোগাযোগ মাধ্যমে নেতাগিরি দেখাতেই ব্যস্ত রয়েছেন কর্মীরা। কেবল তাই-ই নয়, দলের সিনিয়র নেতাদের নির্লজ্জ ভাষায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দলে বিবেধ সৃষ্টি করছেন অনেকে। ফেসবুকে অযাচিত লেখালেখির কারণে বিভিন্ন এলাকায় সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।কিন্তু যাদের যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমেও সরব উপস্থিতি, মাঠে তাদের অবস্থান শূন্যের কোঠায়। অথচ বড় নেতা সেজে তারাই সুবিধা ভোগ করছেন বেশি। সম্প্রতি যোগাযোগ মাধ্যমে এক প্রতিক্রিয়ায় তা স্বীকার করে সাধু-সাবধান বলে কর্মীদের সতর্ক করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন।

এটা কেবল সিলেটের সমস্যা নয়। দেশের সর্বত্র এখন শিষ্টাচার বহির্ভূত এমন রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অথচ নির্বাচন আসলে গ্রামগঞ্জে বসবাসরত দলের যারা প্রাণ, সেই তৃণমূলের খোঁজখবর কয়জন নেতা নেন, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমান সময়ে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, ভোটের রাজনীতিতে এদের কথায় কেউ নৌকায় ভোট দেবে না। বরং নৌকায় ভোট দেবে, গ্রামে বসে থাকা দলের নিবেদিত প্রাণ সেই ব্যক্তিদের কথায়, যারা আজ সুবিধাভোগী আর ক্ষমতার অপব্যাবহারকারীদের দাপটে নিজেকে ঘুটিয়ে রেখেছেন। কিছু কিছু নেতা দল আজীবন ক্ষমতায় থাকবে, এমন মনোভাব নিয়ে কাউকে পরোয়া পর্যন্তও করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে দলের ভিতর ঐক্য, সমন্নয় এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারলে আগামী নির্বাচনে সিলেটের ১৯ আসনের অধিকাংশ আসনই আওয়ামী লীগকে হারাতে হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন দলের ত্যাগী নেতারা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn