হাওরের পানিতে বাঁধা জীবন-১

মুন্না রায়হান ও মোঃ বুরহান উদ্দিন-

চারদিকে হাওরের থই থই পানি। অথচ প্রতিবছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এখানে মাঠের পর মাঠ বোরো আবাদে ভরে যায়। কিন্তু এবার এখনো হাওরের পানি নামেনি। তাই আবাদ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কৃষক। কারণ প্রতিবছর অন্য এলাকার এক মাস আগে নভেম্বরের শুরুতেই আবাদ করেও ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। কিন্তু এবার যে ডিসেম্বরেও বোরো বীজ বপন করতেই পারননি। তা হলে কি হবে এবার। গত বছরের মতো এবারও কি বন্যায় ফসল ভেসে যাবে? তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা শুক্কুর আলী হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে বললেন, এটা আঙ্গারুলী হাওর। এখানে গত বছর নভেম্বরে কোনো পানি ছিল না। কিন্তু এবার এখনো পানি নামেনি। তা হলে বোরো বীজ বুনব কবে। গত বছর নভেম্বরে বোরো আবাদ করে ঘরে তুলতে পারিনি, তা হলে এবার কি হবে? একইকথা বললেন, রাজদরপুর এলাকার ফারুক হোসেন। বেহেলী উপজেলার ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্যানেল চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, হাওরে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো জমি। সেই জমির ফসল তলিয়ে বা কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে বাঁচার আর কোনো পথ থাকে না।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার আঙ্গারুলী হাওর, ধর্মপাশার চন্দ্র সোনারতাল হাওর, ধানকুনিয়া হাওরসহ কয়েকটি হাওরে সরেজমিনে গেলে তারা এ কথা বলেন।সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে হাওরে ফসলহানি হয়েছে আট বার। গত বছর অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৭ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পথে বসে গেছে হাওরবাসী। সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ৯১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কমিটি গঠনের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও কোথাও কমিটি হয়নি। অথচ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এসব পিআইসি গঠনের সর্বশেষ সময়সীমা ছিল। পিআইসি গঠনের ক্ষেত্রে উপজেলা কমিটি বাঁধের সন্নিকটবর্তী জমির প্রকৃত মালিকদের দিয়ে করার কথা। পিআইসি গঠনে বিলম্ব হওয়ার বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছেন না হাওরপাড়ের কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, যেহেতু সবার দাবির প্রেক্ষিতে এবছর হাওরের সকল বাঁধ নির্মাণ করবে পিআইসি, তাই দ্রুত পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু ও সমাপ্ত করতে হবে। না হলে বোরো ফসল ঝুঁকিতে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যগণ পিআইসির সভাপতি হতেন। ৫ সদস্যের পিআইসিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য মনোনীত ৩ জন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনোনীত সদস্য ১ জন থাকতেন। অনেক ক্ষেত্রে সদস্য মনোনয়নে বিলম্বের কারণে পিআইসি গঠন ও বাঁধের কাজ শুরু হতে দেরি হতো। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এবার হাওরপাড়ের কৃষকদের দিয়েই পিআইসি গঠন করা হবে। হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম-আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতেই ২৩ নভেম্বর রাতে জানানো হয়েছে কোনো পিআইসি গঠন করা হয়নি। দ্রুত পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করতে হবে। পাউবোর সুনামগঞ্জ পওর বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিকি ভুইয়া ও পওর বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.শাহিনুজ্জামান বলেন, আমরা বেশ আগ থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণকে বার বার অনুরোধ করে আসছি। কিন্তু পিআইসির তালিকা আমরা পাইনি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী বোরো ফসল রক্ষায় হাওরপাড়ের কৃষকদের দিয়েই পিআইসি গঠনের পাশাপাশি হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য অনুন্নয়ন খাতে ২৮ কোটি ৮৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যদিও এ খাতে চাহিদা ৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া উন্নয়নখাতে বরাদ্দ হয়েছে ৩১ কোটি ৫২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

সুনামগঞ্জ পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিকি ভুইয়া জানিয়েছেন, পিআইসির তৃতীয় কিস্তির টাকা ছাড় দেবার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন তাঁরা। তবে জেলার কোথাও এখনো পিআইসি গঠনই হয়নি। হাওরের পানি না নামায় এই বিলম্ব হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, হাওরে ফসল রক্ষায় আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে হাওরে এখনো পানি না নামায় কাজ করা যাচ্ছে না। বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাওরের কৃষকরা বিআর-২৯ আবাদ করেন। কিন্তু এই আবাদ ঘরে তুলতে ৬০ থেকে ৬৫ দিন সময় লাগে। তাই তাদেরকে বিআর-২৮ আবাদের পরামর্শ দিয়েছি। বিআর-২৮ ধান ৩০ থেকে ৩৫ দিনেই ঘরে তোলা যায়। এতে বন্যার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে ফসল।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn