শাহরীয়ার বিপ্লব(ফেসবুক থেকে)-

৯৫ সনের মাঝামাঝি। ট্রেনিং এর মিডটার্ম ছুটিতে এসেছি। যাবার সময় ভাবলাম লীডারকে একটা সালাম দিয়ে যাই। ৮৩ লেক সার্কাস, কলা বাগান। বাসায় গিয়ে দেখি মানুষ নেই। খবর দিতেই লীডার নেমে এলেন। তখন মাগরিবের আযান হবে। সালাম করতেই তিনি হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদে নিয়ে এলেন। নামাজের পরে বাসায় গিয়ে বসি। লীডার উপরে গেলেন আর নামছেন না। প্রায় আটটা বেজে যাচ্ছে। আমার সাথের কলিগ বিরক্ত। সারদা যাবার সময় হয়ে আসছে। কিন্তু না বলে তো আর যেতে পারছি না। ৯ টার সময় তিনি এলেন। এসেই এমন ভাবে আলাপ জুড়লেন মনে হলো আমি না জ ানি কত বড়নেতা। আমি উশখুশ করছিলাম। তিনি বুঝতে পারছিলেন। বললেন, আহা অস্থিরতা করলে তো চাকরী করা যাবে না। এটাই ট্রেনিং। ধৈর্য ধরা শিখতে হবে। চাকরী বলো আর রাজনীতি বলো এই দুইটাতেই সফলতার একমাত্র উপায় হলো ধৈর্য। কাউরে ভুল বুঝিবার আগে চিন্তা করবায়। ভুল করিয়া কেউর ক্ষতি করলে তার চেয়ে তুমার ক্ষতি বেশী অইবো। আর টেখার পিছে ঘুরবায় না। ইজ্জতের পিছে ঘুরবায়। এই গুলা বলে আবার রাজনীতির আলাপে চলে গেলেন। আমার কলিগ কিছুই বুঝতে পারছিল না। কারন উনি কোথাকার আলাপ যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, তা উনার কাছে কেউ না এলে বুঝতে পারবে না। হঠাৎ করে বলেন, ভাত খাইয়া যাইও।তোমরার বাসের টাইম আমার জানা আছে। বলে তিনি আবার উপরে উঠে গেলেন।

ট্রেনিং শেষ করে এসে যখন ঢাকায় জয়েন করি, তখন অসহযোগ আন্দোলনের কিছুদিন আগে। ডিউটির এমন চাপ। লীডারের বাসায় যাবার সময় পাই নাই। ইত্তেফাকের মোড়ে একদিন ডিউটি করছি। তিনটার দিকে হঠাৎ করে আমার পাশে একটা প্রাইভেট কার থামলো। গ্লাস নামিয়ে আমাকে ডাকছে ড্রাইভার। কাছে গিয়ে দেখি সামনের সীটে গানম্যান বাশার ভাই আর পিছনে লীডার বসা। আমি দরজা খুলে সালাম করতে চাইলাম। উনি বাধা দিয়ে বললেন, সালাম পরে, আগে মসজিদ টা দেখাইয়া দেও। আমি আশেপাশে কোন মসজিদ চিনি না। তবে বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদের বাইরের দিকে একটা পকেট গেইট দিয়ে ভি তরে নামাজের ব্যবস্থা আছে বললাম। তিনি এমন বিরক্ত হয়ে বললেন, এর তো ট্রেনিংয়েই হয় নাই। বাশারের দিকে তাকিয়ে বললেন চলো সামনের দিকে। আমি বুঝে গেলাম লীডারের বিরক্তির কারন। চট করে গাড়িতে উঠে বললাম, ইখানো যাওয়া লাগবো না আউকা ভালা যাগাত লইয়া যাই। বলে পাশেই কমিউনিটি সেন্টারের মালিকের রুমে নিয়া ওজু ও নামাজের ব্যবস্থা করে দেই। লীডার নামাজ পড়তে পড়তে বাশার ভাইয়ের পরামর্শ মতো কাচ্চি বিরিয়ানি ফিরনি বোরহানি রেডি করে মালিকের টেবিলে সাজিয়ে রাখি। নামাজ পড়ে এই আয়োজন দেখে বাশার ভাইকে বললেন, ফানির দেশর ফোয়াইন বেখল থাকইন। এইটা আরো বেশী বেখল। এরে ট্রেনিং করাও ভালা কইরা। আমার দিকে তাকিয়ে বাশার ভাই বললেন, বুঝছেন নি কেন আপনাকে বেক্কল বলছেন? আমি মাথা নাড়ি। খাওয়ার মাঝখানে বাশার ভাই আবার আস্তে বললেন যাতে লীডার না শুনেন, দোয়া করেন যাতে বঙ্গভবন ঢুকতে পারি। তখন আপনি থাকবেন পাইলট। এতো আস্তে করে বল্লো আমিই ভালো করে বুঝি নি। কিন্তু লীডার শুনে ফেললেন। হেসে হেসে বললেন, এ যদি পাইলট হয়, কই থাকি কই নিব টার ফাইবায় নি? দেখছ নি কই নিয়া হারছিল?

ইতিমধ্যে এই এলাকার নেতা মঞ্জুসহ অনেক নেতাকর্মী কমিউনিটি সেন্টারের সামনে জমা হয়ে গেছেন। পুলিশের গাড়িও এসে গেছে। নিশ্চয়ই এসবি ও এসেছে । বেরুবার সময় নেতারা শ্লোগান দিচ্ছেন। তিনি থামিয়ে দিয়ে মঞ্জুকে ডেকে কানে কানে কি বললেন। আর বক্তৃতা করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই সরকারের পুলিশের জন্যে নামাজ পড়াও যাবে না। নামাজ পরতে এসেছি তাও আপনারা বাধা দিচ্ছেন, আপনি পুলিশের গাড়ী নিয়ে এসে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। বাংলার জনগণ পুলিশকে ভয় পায় না। যান আপনার অফিসারকে বলেন, তারা যেন সরকারের গোলাম না হয়। বলে আমাকে আংগুলে ইশারা দিলেন, দূরে সরে যেতে। আমি পুলিশের গাড়ির কাছে চলে এসেছি। লীডার বাইরে এসে মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেছেন।

আমার উপর দেয়া গরম বক্তব্যের কারনে ওসি আর এসবি দুইজনেই আমার উপর সিমপ্যাথি দেখিয়েছেন। কিছুই জানলেন না। সন্ধ্যার পর আওয়ামীলীগ নেতা মঞ্জু ভাই এসে আমাকে যে কি করবেন তার ঠিক নাই। কারন লীডার তাকে কানে কানে বলে গিয়েছেন, ছেলেটা আমার লোক। লীডারের আর বঙ্গভবন যাওয়া হয় নি। দীর্ঘচাকুরি জীবনে প্রায় শতবার পাইলটিং ডিউটি করেছি। যতবার এই দায়িত্ব পালন করেছি ততবার লীডারের কথা মনে করে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিদেশী অতিথির দায়িত্বপালন করেছি। কিন্তু আপনার পাইলটিং করা হয়নি আর আপনার জীবিতাবস্থায়। তবে একদিন করেছি। আজকের এই দিনে। সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ, আর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ থেকে আবার এয়ারপোর্ট এবং সর্বশেষ রানওয়ের ভিতর দিয়ে হেলিকপ্টার পর্যন্ত। সবই অলিখিত, আনঅফিসিয়েলি। আমার এস পি সাহেব ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তোমার তো চাকুরী থাকবে না। এডিশনার এস পি ফারুকী স্যার বলেছিলেন, স্যার করতে দেন। ওর বুকটা হালকা হোক। লীডার এখনো যাই। পাইলটিং করি। ৮৩, লেক সার্কাস, কলাবাগান থেকে, বনানী কবরস্থান। তবে একা। সিভিলে। নীরবে। নিভৃতে।।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn