জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি-

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে। দীর্ঘ শুনানি গ্রহণ শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান রায় ঘোষণার এ দিন ঠিক করেন। মামলায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বড় ছেলে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জন আসামি রয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যেসব মামলা হয় তারই একটি এই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় করা এ মামলায় এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। এ মামলায় দীর্ঘ ১৬ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে মামলার উভয়পক্ষ। এরপর মামলাটি রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হয়। একই আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটিরও শুনানি চলছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীসহ এ মামলার আসামি ৫ জন। মামলায় আগামী ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তিতর্ক শুনানির দিন ঠিক করেন বিচারক।

রায়ের দিন ধার্য করার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুুর রেজ্জাক খান এবং আহসানউল্লাহ বলেন, প্রসিকিউশন কোনো অভিযোগই আসামিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে পারেনি। আশা করি খালেদা জিয়াসহ সব আসামি খালাস পাবেন। অন্যদিকে দুদকের প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, আমরা ৩২ জন সাক্ষী এবং ডকুমেন্ট দিয়ে সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। তাই আশা করছি রায়ে সব আসামি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন শাস্তিই পাবে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে খালেদা জিয়া ওই আদালতে উপস্থিত হন। তবে তিনি আসার আগেই এদিন ১১টা ৭ মিনিটে বিচারক আখতারুজ্জামন এজলাসে উঠে মামলার কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুতে আইনজীবী আহসানউল্লাহ তার ষষ্ঠ দিনের যুক্তি উপস্থপন শুরু করেন। যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আগে তিনি বলেন, এই মামলায় ম্যাডাম খালেদা জিয়াও তাকে পাওয়ার (ওকালতনামা) দিয়েছেন, যেন তার প্রসঙ্গ এলেও কথা বলতে পারেন। এ সময় বিচারক বলেন, আপনাকে আজ যুক্তিতর্ক শেষ করতে হবে। আপনি আজ লাঞ্চ (দুপুরের বিরতি) পর্যন্ত সময় পাবেন। এরপর পিপি সাহেব বলবেন। জবাবে আইনজীবী আহসানউল্লাহ বলেন, বিনা দোষে জেল খাটার চেয়ে যাতে জেল খাটতে না হয় তা বোঝানোর জন্যই আমি একটু সময় নিয়েছি। তবে বিজ্ঞ আদালত যাই বলবেন তাই হবে। এই আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে আদালতকে বলেন, এ রকম মামলা এই উপমহাদেশে খুঁজে একটিও পাইনি। তবে অপরাধজনক বিশ^াসভঙ্গ কোন ক্ষেত্রে হয় আর কোন ক্ষেত্রে হয় নাÑ এ বিষয়ে আমি উচ্চ আদালতের কিছু নজির এই আদালতে উপস্থাপন করব। এরপর তিনি বাংলাদেশ হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ ও পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্টের এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। এরপর তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের কেস ট্রাস্ট সৃষ্টির পর থেকে। যদি তাই হয় তবে খালেদা জিয়া এবং কামালউদ্দিন সিদ্দিকীর কোনো ভূমিকাই এখানে নেই। সরফুদ্দিন ট্রাস্টের কাছে জমি বিক্রেতা এবং সলিমুল হক কামাল ব্যাংকে টাকা রেখেছেন মাত্র। তাদের কোনো দায়বদ্ধতাই আসে না। আর টাকাগুলোর যেহেতু কোনো অপচয় হয়নি বরং সুদে-আসলে এখন অনেকগুণ হয়েছে তাই কোনো আসামিরই এখানে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। তিনি সর্বশেষ একটি গল্প উল্লেখ করে বলেন, এই মামলায় শুধু পাতা খস খসের শব্দই আছে। কোনো বাঘ-বাগডাশের অবস্থান নেই। তাই বেগম খালেদা জিয়া, সরফুদ্দিন আহমেদ ও সালিমুল হকের বেকসুর খালাস দাবি করছি। এরপর বেলা ১টার দিকে বিচারক ৩০ মিনিটের বিরতিতে গিয়ে বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন। ওই সময় আইনজীবী মিজানুর রহমান আসামি সরফুদ্দিন এবং সালিমুল হক কামালের পক্ষে আইনগত পয়েন্টের ওপর ১ ঘণ্টা যুক্তি উপস্থাপন করে একইভাবে তাদের খালাস দাবি করেন। এরপর দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল আসামি পক্ষের যুক্তি খ-নের বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, মামলাটিতে গত ১৯ ডিসেম্বর আমরা মাত্র ২ ঘণ্টা যুক্তি উপস্থাপন করি। আর আসামিপক্ষ ১৬টি ধার্য তারিখে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তারা মামলাটি আমলে নেওয়ার, চার্জের বিরুদ্ধে, নোটিশের বিরুদ্ধে ও পুনঃতদন্তের জন্য উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমরা ৩২ জন সাক্ষী দিয়ে এবং সঙ্গে ডকুমেন্ট দ¦ারা আদালতে সব আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি অপরাধজনক বিশ^াসভঙ্গের বিষয়ে উচ্চ আদালতে ২টি সিদ্ধান্ত দিচ্ছি। তারা বলেছেন, মামলার ডকুমেন্ট জালিয়াতি হয়েছে। আসলে কারা ডকুমেন্ট জালিয়াতি করেছে তা আমরা বিজ্ঞ আদালতের রায়ে পাব। এ সময় পিপি কাজল ফ্যাক্টের ওপর কথা বলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বাধা দেন। ওই সময় পিপি কাজল বলেন, আঙুল উঁচিয়ে কথা বলবেন না। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উচ্চ বাক্যবিনিয়ম হয়। একপর্যায়ে সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, পিপি সাহেব সিনিয়র-জুনিয়র বোঝেন না। আর আপনার (বিচারক) রায়ে কি আসবে তা তিনি কীভাবে বলে দেন। এরপর রেজ্জাক খান বলেন, আমরা ল পয়েন্টে কিছু বলব। তবে আজ তো সময় শেষ। ওই সময় বিচারক বলেন, যা বলবার আজই বলুন। এরপর রেজ্জাক খান বলেন, যদি জোর করেন তো বলতেই হবে। এরপর তিনি আসামি পক্ষে উপস্থাপিত অধিকাংশ যুক্তি প্রসিকিউশন খ-ন করতে পারেননি মর্মে দাবি করেন। এরপর উভয় পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হওয়ায় বিচারক আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি অরফানেজ মামলায় রায় এবং ৩০, ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি চ্যারিটেবল মামলায় যুক্তিতর্কের দিন ধার্য করেন। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে খালেদা জিয়া আদালত অঙ্গন ছেড়ে যান। এর আগে ১৯ ডিসেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। ওইদিন দুদকের পক্ষে মোশারফ হোসেন কাজল প্রায় ২ ঘণ্টা যুক্তি উপস্থাপন করে শেষ করেন। এরপর ওইদিন খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। গত ২০, ২১, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর এবং ৩, ৪, ১০, ১১ ও ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা। খালেদার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী মওদুদ আহমদের আগে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মাদ আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুুর রেজ্জাক খান, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। এরও আগে গত ১৯ ও ২৬ অক্টোবর এবং ২, ৯, ১৬ ও ২২ নভেম্বর ধার্য তারিখসমূহে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য প্রদান করে তিনি খালাস পাওয়ার যোগ্য বলে দাবি করেন। ২০০৮ সালের জুলাইয়ে করা এ মামলায় ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলাটিতে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগপত্রে খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়াও সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে আসামি করা হয়। মামলায় তারেক রহমান, কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান পলাতক। এ কারণে তাদের পক্ষে কোনো যুক্তি উপস্থাপন হয়নি আদালতে।

অভিযোগ প্রমাণ হলে যা হতে পারে

 কবির হোসেন ও রহমান জাহিদ-
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করবেন আদালত। এ মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জন আসামি রয়েছেন। রায় ঘোষণার দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর অভিযোগ প্রমাণ হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের এ মামলায় কত বছর দ- হতে পারে, দ-িত হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে কিনাÑ এসব প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। জানা গেছে, আইনের যে ধারায় এ মামলা হয়েছে, তাতে দোষীসাব্যস্ত হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে। আইনে সর্বনিম্ন দ- কত হতে পারে তা বলা নেই, যা আদালতে বিবেচনার ওপর নির্ভর করে বলেও জানা গেছে। তবে এ মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে এবং বিচারিক আদালতে দ-িত হলে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কী পারবেন না- তা সুস্পষ্ট নয়।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা আছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’ তা হলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। দ-প্রাপ্ত ব্যক্তির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ কতটুকু সে ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় দ-প্রাপ্ত হলে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক বার (বাধা) রয়েছে। ন্যূনতম দুই বছর দ-প্রাপ্ত হলে এবং তার পর ৫ বছর অতিবাহিত না হলে সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।’ হাইকোর্ট যদি সাজা স্থগিত করে এবং আসামিকে জামিন দেয়, সে ক্ষেত্রে পারবে কিনা জানতে চাইলে সাবেক এ আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাজা স্থগিত করলে তো সাজা বাতিল হলো না। সাজা খাটা হলো না। সে ক্ষেত্রে পারবে না।’ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দুর্নীতির মামলায় দ-প্রাপ্তরা আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এ বিষয়টি নজরে আনা হলে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, যদি উচ্চ আদালতে আবেদন করে এবং আবেদনের যুক্তি দেখে আদালত সন্তুষ্টিসাপেক্ষে অনুমতি দেন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। ড. শাহদীন মালিক এ বিষয়ে বলেন, আমি যতদূর জানি, ফৌজদারি অপরাধে দ-প্রাপ্ত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখনো সেটেল হয়নি। কোনো রায়ে নেই, আবার আইনও হয়নি। অনেক আগে একটি রায়ে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন বলেছিলেন, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। আর বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন পারবে না। এ বিষয়টির সুরাহা হওয়ার জন্য তৃতীয় কোনো বেঞ্চে যায়নি। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও লুৎফুজ্জামান বাবরের বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, তাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণের ব্যাপারে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এখনো সেটেল হয়নি। এ বিষয়টি পুরো অস্পষ্ট রয়েছে। জানা যায়, মামলাটিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলার অপর আসামিরা হলেন সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। আসামিদের মধ্যে খালেদা জিয়া ও ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী হিসেবে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এবং দ-বিধির ৪০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। অপর আসামি তারেক রহমান, সালিমুল হক কামাল, শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৪০৯ ধারার অপরাধের সহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে দ-বিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। দ-বিধির ৪০৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী, একজন ব্যাংকার, বণিক আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি অথবা প্রতিনিধি হিসেবে কোনো প্রকার সম্পত্তি বা সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে উক্ত সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধজনক বিশ^াস ভঙ্গ করে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদ-ে বা যে কোনো বর্ণনার কারাদ- যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে, দ-িত হবে এবং অর্থদ-েও দ-নীয় হবে। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো আর্থিক সম্পদ বা সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক অসদাচরণ করে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে সেই ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত কারাদ- বা জরিমানা দ-ে দ-িত হবেন এবং উক্ত আর্থিক সম্পদ বা সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দ হবে। দ-বিধির ৪০৯ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয় আসামির সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- হতে পারে এবং অর্থদ- হবে। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে খালেদা জিয়া এবং কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ- বা জরিমানা হিসেবে অর্থদ-ও দ- হতে পারে। এই ধারায় আদালত কারাদ- না দিয়ে শুধু জরিমানা দ-ও করতে পারেন। কেননা এই ধারায় সাত বছরের কারাদ- বা জরিমানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে উভয় ধারায়ই সর্বনিম্ন দ- কত হবে উল্লেখ না থাকায় তা আদালতে ইচ্ছাধীন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

সাজা হলে রাজপথে নামবে বিএনপি

নজরুল ইসলাম
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ২৪টি মামলাসহ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫০ হাজার ৭৪টি মামলা হয়েছে। এই নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা নানা শঙ্কায় ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ শেষে গতকাল আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ধার্য করেছেন বিশেষ জজ আদালত। বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচনের এই বছরে এই রায় কী হতে পারে এই নিয়ে বিরাজমান শঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে দলের নেতাদের। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে দীর্ঘদিন থেকে যে রোডম্যাপ অনুযায়ী এগোচ্ছিল তাতেও পরিবর্তন আসবে। আইনি মোকাবিলার চেয়ে বিএনপি রাজপথকেই অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের সময়কে বলেন, তাড়াহুড়া করে যেভাবে দেশনেত্রীর মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের। দ্বিতীয়ত, আদালতে যে যুক্তিতর্ক দেখেছিÑ তাতে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এ মামলা। বিচারকের ওপর কোনো ধরনের চাপ না থাকলে এই মামলার রায়ে নেগেটিভ কিছু হবে এমনটা আমরা মনে করি না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা আবার দেশে একটি একদলীয় নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। মামলা-হামলা করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা যাবে না। জনগণ এবার তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না।
খালেদা জিয়া ও বিএনপি অভিন্ন মনে করে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছেÑ এসব ভিত্তিহীন। দেশে-বিদেশের সব মহলই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এসব নেতা অভিন্ন সুরে বলেন, বিএনপিকে বাঁচাতে হলে খালেদা জিয়ার জন্য রাজপথে নামা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। করণীয় ঠিক করতে গতকাল রাতে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা গুলশান কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন। এর আগের দিন বুধবার রাতেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে আইনিভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি রাজপথকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মতপ্রকাশ করেছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানও এই নিয়ে বেশ তৎপর। এই নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যোগাযোগ রাখছেন। বেগম জিয়ার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম পূর্বনির্ধারিত আজ শুক্রবার মুন্সীগঞ্জে এক স্মরণসভার কর্মসূচি বাতিল করেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) মামলার রায় এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাসদ ও জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের হাতে হাতে। তাই এই রায় কী হবে তা তো সবারই অনুমেয়। সরকারের উদ্দেশ্যÑ ম্যাডামকে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। ভিত্তিহীন এই মামলায় যদি ম্যাডামের সাজা হয় তা হলে আমরা আইনি ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করব। ম্যাডামের সাজা হলে কিসের নির্বাচন, কিসের কি? দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আর সরকারের উদ্দেশ্যও সফল হবে না। বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা হয়েছে। মামলার সংখ্যা অনুযায়ীÑ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৮টি, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫২টি ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৩৭টি। তরিকুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪টি করে মামলা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি করে মামলা। নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৭টি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা রয়েছে। এমকে আনোয়ার ৩৪টি মামলা মাথায় নিয়ে মারা গেছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা হয়েছে। চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি মামলা। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মামলা সংখ্যা সারওয়ারী রহমানের ৬টি, রিয়াজ রহমানের ২টি, এজে মোহাম্মদ আলীর ৬টি, আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ৯৬টি, মিজানুর রহমান মিনুর ২৪টি, তৈমূর আলম খন্দকার ১৩টি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৪টি, আবদুল্লাহ আল নোমান ৬টি, বরকতউল্লাহ বুলু ৬১টি, মো. শাহজাহান ৯টি, আবদুল আউয়াল মিন্টু ৭টি, শামসুজ্জামান দুদু ১৭টি, ব্যারিস্টার আমিনুল হক ২৩টি, মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন ৬টি, মজিবুর রহমান সরোয়ার ১৩টি, জয়নাল আবদীন ফারুক ৪৭টি, আতাউর রহমান ঢালী ১৩টি, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ৪১টি, খায়রুল কবির খোকন ১৪, হাবীব-উন নবী খান সোহেল ১২৯টি, হারুন-অর রশিদ ১৩টি, আসলাম চৌধুরী ৯টি, নাদিম মোস্তফা ২৯টি, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ২৯টি, এবিএম মোশাররফ হোসেন ১৩টি, আজিজুল বারী হেলাল ২৯টি, বিলকিস জাহান শিরীন ৯টি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ৪৭টি, ফজলুল হক মিলন ৯টি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু আকন কুদ্দুসুর রহমান ৬টি, তাইফুল ইসলাম টিপু ৬টি, শিরীন সুলতানা ১২টি, আসাদুল হাবিব দুলু ১৩টি। এ ছাড়াও দেড় শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে সরকার এসব করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা ২৪টি মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যেভাবে বিরোধী দলকে নির্মূল করতে ও বিরোধী দলকে পুরোপুরি মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সেভাবে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে, হত্যা করছে,গুম করেছে। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ বিভাগে মোট মামলা হয়েছে ৫২৮টি, আসামির সংখ্যা ২৪ হাজার ৭শ ৭ জন। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১৫১৯, গুম হয়েছেন ১ জন, খুন হয়েছেন ১ জন। ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলার সংখ্যা ৫০ হাজার ৭৪টি। আসামির সংখ্যা ১১ লাখ ৯১ হাজার ৪৪৯ জন। খুন হয়েছেন ৭৭৩ জন। এখনো জেলহাজতে ৩ হাজার ৯৪৭ জন নেতাকর্মী।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn