আল-হেলাল : জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ ও সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্ জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের প্রদর্শিত পথে সুনামগঞ্জকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহবাণ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন,সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি শুধুমাত্র একজন সাহসী সৎ বিচক্ষণ রাজনীতিবিদই ছিলেননা তিনি ছিলেন সংসদীয় ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদ ও প্রাণপুরুষ। তিনি সংসদ সদস্যদের শিক্ষাগুরু ছিলেন।

১৯৭০ সালে বিপুল ভোটে বিরোধীদলের অন্যতম এমপি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আজকে যে জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সেসময় এখানেই জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসতো। প্রথমবার সংসদের অধিবেশনে গিয়ে তিনি বারবার ফ্লোর চাচ্ছেন। কিন্তু স্পীকার তাকে দেখছেননা বা ফ্লোর দিচ্ছেননা। তখন বিরতির সময় তার প্রতি বিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান মিজানুর রহমান চৌধুরীর মায়া হয়। হ্যালো ইয়াংমেন বলে তিনি তাকে কাছে ঢেকে নেন। বলেন তুমি বারবার দাড়িয়ে কি যেন বলতে চেয়েছিলে। তুমি বিরতির পর আরেকবার এভাবেই চেষ্টা করবে আমি তোমাকে সহযোগীতা করবো। তখন মিজান চৌধুরী সংসদে দাড়িয়ে স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপিকে ফ্লোর দেওয়ার অনুরোধ করলে প্রথমে দাড়িয়ে তিনি তার দলের দেয়া তথ্য উপাত্ত নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

আরেকবার সংসদে ফ্লোর না পেয়ে তিনি রেগে সংসদ অধিবেশন ছেড়ে বাসায় চলে যান। বিষয়টি সংসদ নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নজরে পড়ে। তখন বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করেন তার বাসায়। জাতির জনকের ফোন সেদিন রিসিভ করেন বৌদি ড.জয়াসেন গুপ্তা। তিনি ফোনের রিসিভার সুরঞ্জিত দার হাতে তুলে দিলে বঙ্গবন্ধু তাকে সংসদে ঢেকে নেন। এবং তাকে বক্তব্যর সুযোগ দিয়ে বলেন, তুই হচ্ছিস আমার গণতন্ত্র। তুইতো সংসদে কথা বলবে। তোর যা ইচ্ছা তাই বলিস। তোর জন্য সংসদের অধিবেশন সবসময় উন্মুক্ত।

২৯ মে শনিবার রাতে সুনামগঞ্জের শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা ও মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ একথা বলেন।

প্রণব কুমার তালুকদার মিন্টুর সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক শামস শামীমের পরিচালনায় মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা কোহিনূর রহমান, লেখক সুখেন্দু কুমার সেন, সাবেক সাংসদ আব্দুজ জহুরের পুত্র জেলা আওয়ামীলীগ নেতা জুনেদ আহমদ, সুনামগঞ্জ খবর পত্রিকার সম্পাদক পংকজ কান্তি দে ও সাংবাদিক খলিল রহমান প্রমুখ।

হুইপ মিসবাহ এমপি বলেন,সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি ফটোগ্রাফিক্স মেমোরির অধিকারী ছিলেন। যা দেখতেন এবং পড়তেন তাই তার মুখস্থ হয়ে যেত। এবং মুখস্থ হওয়া বিষয়গুলো যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানেই তিনি রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগাতেন। তিনি একজন সফল নাট্যাভিনেতা ছিলেন। এমসি কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি সেক্সপিয়ারের নাটকে অভিনয় করে পান্ডিত্য দেখান। তাঁর চমৎকার বাচনভঙ্গি ও সুস্পষ্ট বক্তব্য সকলকেই আকৃষ্ট করতো। একবার সংসদে গোলাপী শাড়ি পড়ে বসে আছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আওয়ামীলীগ এমপিরা একটি বিষয়ে কথা বলছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোন সদুত্তর দিচ্ছেননা। প্রধানমন্ত্রীর এই রহস্যজনক নিরবতা দেখে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমার গল্প টেনে আনলেন। বললেন,এই সংসদেও আমি বলি, একটা কথা কও গোলাপী একটা কথা কও। এইরকম বিজ্ঞ, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং অসাধারন পান্ডিত্যর অধিকারী ছিলেন তিনি। 

সংসদে তার দেয়া বক্তব্যগুলো নিয়ে যদি কোন প্রকাশনা হয় তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম এ থেকে জ্ঞান আহরন করতে পারবে। গবেষণা এবং রেফারেন্স এর অনেক কাজে লাগবে তার বক্তব্যগুলো।

তিনি আরো বলেন,কুখ্যাত ইনডেমনিটি এ্যাক্ট প্রণয়ন নিয়ে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত সংসদে দাড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন শিশুসহ একজন রাষ্ট্রনায়ক ও তার পরিবারকে জগন্যভাবে হত্যা করা হয়েছে। আপনারা সংখ্যালঘু হওয়া এবং ক্ষমতার জোরে আজকে যে কুখ্যাত কালাকানুন করছেন এমন একদিন আসবে যেদিন আপনাদেরকে এ সংসদে দূর্বিণ দিয়েও খুজে পাওয়া যাবেনা। আজ তাঁর কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

“বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েনা” এবং দলীয় সভায় সভানেত্রীকে উদ্দেশ্য করে “আর কেউ মুনাযাত পড়ালে হয়তো কবুল নাও হতে পারে আপনিই মুনাযাত পড়ান”এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি নেত্রীকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দলীয় নেতা কর্মীদেরকেও সতর্ক করে দিতেন।

সর্বশেষ তিনি যখন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তখন দেখতাম তিনি প্রতিদিন নিয়মিত সংসদে অফিস করতেন। আমি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সবসময় তার সাথে থাকতাম এবং তাঁকে অনুস্মরণ করতাম। মৃত্যুর আগে ঢাকাস্থ সুনামগঞ্জ সমিতির একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমিও অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। শেষবার ল্যাবএইড হাসপাতালে আমি তার শয্যাপাশে ছিলাম। আমাকে পেয়ে আলাপ আলোচনার পর তিনি আমার ভাই সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানকে খুজে বেড়ান। আমি তাঁর সাথে আমার মোবাইলেই হাবিব ভাইকে আলাপ করিয়ে দেই।  

আজ তিনি দৈহিকভাবে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও এই দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে, সংসদে, রাজনীতিতে তিনি যে সক্রিয় অবদান রেখে গেছেন সেটি যুগের পর যুগ এই দেশে অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর অবদানের জন্য আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।

তিনি বলেন, সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু ও শামস শামীম কোন উপকারভোগী বা তাঁর পরিবারের কেউ না হওয়ার পরও তাঁকে ভালবেসে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনার মাধ্যমে যে মহৎ কাজটি করেছেন সেজন্য আমি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। 

উল্লেখ্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপিসহ ২৬ জন লেখকের লেখা নিয়ে সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু ও শামস শামীমের যৌথ সম্পাদনায় ১৫৯ পৃষ্টার “সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত”স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এটির মোড়ক উন্মোচন করেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ ও সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ।

এর আগে ২০১২ সালের ২৮ জানুয়ারি সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপির জীবদ্ধশায় “শ্রেষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত” নামে একখানা জীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন সাংবাদিক আল-হেলাল। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহান এই রাজনীতিবিদের মহাপ্রয়াণের পর তার জীবনকর্ম ও রাজনীতি নিয়ে “সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ভেতরে বাহিরে”নামে একখানা গ্রন্থ প্রকাশ করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক দীপক চৌধুরী।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn