“You can not expect a man to live, fight and die in the East Pakistan and go to Jhelum for sex, would you?”– জেনারেল নিয়াজী

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ‘পশুসুলভ’ মনমানসিকতার কারণে নারী পৃথিবীর প্রতিটি যুদ্ধেই হয়েছে সর্বাধিক আক্রান্ত, সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত। যুদ্ধে নর-হত্যার পাশাপাশি বিপরীত পক্ষের নারীদেরকে শুধু হত্যাই করা হয় না, বরং এরই সাথে তাদের ওপর চালানো হয় তীব্র যৌন নির্যাতন। সে নির্যাতনের উদ্দেশ্য কখনো থাকে জৈবিক ভোগ লালসা মেটানো, কখনোবা থাকে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরী করার প্রয়াস। আর উপরোক্ত বানীটি(!) যদি হয় যুদ্ধাবস্থায় কোন সেনাপতির মুখ নিঃসৃত বাণী, তাহলে সে যুদ্ধে অসহায় নারীদের ভাগ্যে কি জুটেছিল তা সহজেই অনুমেয়। গবেষকদের মতে, ১৯৭১-এ নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা একক যুদ্ধ ও সময়ের হিসাবে পৃথিবীতে সংঘটিত সকল যৌন নির্যাতনের শীর্ষে। নারী নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে লেখা এই নিবন্ধে আমি শুধুমাত্র সিলেট অঞ্চলের যুদ্ধাক্রান্ত নারীদের নিয়ে আলোচনা করব।

নারী ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেকেই “নির্যাতন” শব্দটি ব্যবহার করেন। আসলে “নির্যাতন” শব্দটা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে এত বেশী ব্যবহৃত হয় যে শুধু ‘নারী নির্যাতন’ বললে আমাদের কাছে এখন আর পাকিদের নারী ধর্ষণের ব্যাপকতা কিংবা বীভৎসতা ঠিকমতো ফুটে উঠে না। এই ‘নির্যাতন’ আর ‘ধর্ষণ’ – শব্দ দু’টোর মধ্যে কিন্তু বিস্তর তফাৎ আছে। মুনতাসির মামুন এর মতে, “এই শব্দটির [ধর্ষণ] মধ্যে যেন সংকোচ, লজ্জা লুকিয়ে আছে। ধর্ষিত নারীদেরও যেসব সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে সেখানে তারা ধর্ষণের বদলে ‘অত্যাচার’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শহর গ্রামের সবাই। ‘নির্যাতন’ থেকে ‘অত্যাচারের’ অর্থ বরং খানিকটা ব্যাপক”।

শুরুতেই কিছু জিনিস আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। বীরাঙ্গনাদের সঠিক সংখ্যা কখনোই হাতে গুনে হিসেব করে বের করা যাবে না, এটা যে কোন দেশের জন্যেই অসম্ভব। আমাদের সমাজ রক্ষণশীল সমাজ, আর এই রক্ষণশীল সমাজে আরো একটু বেশী রক্ষণশীল সিলেট অঞ্চল। তার ওপর যুক্ত হয়েছে বীরাঙ্গনাদেরকে আমাদের সমাজে মেনে না নেয়ার মানসিকতা। তাই স্বভাবতই ৭১-এ ধর্ষণের কথা সেখানে অনুচ্চারিত। নির্যাতিত অনেক হিন্দু পরিবারই যুদ্ধশেষে কিংবা যুদ্ধাবস্থায়ই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন অপমানে, আর মুসলিম পরিবাররা সে কথাগুলো বেমালুম চেপে গিয়েছিল। এ জন্যই অনেক জায়গাতে গবেষকরা বিস্তারিত না দিয়ে শুধুমাত্র বলেছেন, এখানেও ব্যাপক নারী নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের অবস্থা নিয়ে সবচেয়ে বিশদ আলোচনা গবেষণা করেছেন তাজুল মোহাম্মদ। এই নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটা বই আছে। ড এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’ গ্রন্থটিতেও সিলেট সম্পর্কে অনেক কথাই লিপিবদ্ধ করা আছে। এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অপূর্ব শর্মার ‘বীরাঙ্গনা কথা” বইটা। সিলেটের বারোজন বীরাঙ্গনার জীবন কাহিনীর চিত্র বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে এই বইতে।

সিলেট শহরে মূলত পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে শালুটিকরে অবস্থিত সিলেট এয়ারপোর্ট এবং রেসিডেন্সিয়াল কলেজেই (সিলেট ক্যাডেট কলেজ)। শালুটিকরের চ্যাংগের খালে যে কত বাঙ্গালীর রক্ত মিশেছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। অনেকের মতে শুধুমাত্র শালুটিকরেই তিনশত লোকের ওপরে হত্যা করা হয়। সেখানকার নদী ঘাটটির নাম হয়ে গিয়েছিল ‘করাচি বন্দর’। নরহত্যার পাশাপাশি এই ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে নারী নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্রও। শালুটিকরে অবস্থিত এই ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি হেরেমের ছবিগুলো এখনো পাকিস্তানিদের বিকৃত রুচির পরিচয় বহন করে।

শালুটিকরে অবস্থিত এই ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি হেরেমের ছবিগুলো এখনো পাকিস্তানিদের বিকৃত রুচির পরিচয় বহন করে।

১৯৭১-এ মুজিবনগর থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হতো। এই পত্রিকাগুলোতেও মেলে শালুটিকরে নারী ধর্ষণের ব্যাপকতার সাক্ষ্য। ‘সাপ্তাহিক বাংলা’র ১৬ সেপ্টেম্বর ইস্যুতে ‘আম্বরখানা কলোনী ও মডেল স্কুলে ৫ শতাধিক বাঙালী মেয়ে বন্দিনী’  শিরোনামে প্রকাশিত খবরেও স্পষ্ট পাওয়া যায় নারী নির্যাতনের দলিল।

“পাঁচ শতাধিক বাঙালী মেয়ে আজও সিলেট শহরের আম্বরখানা কলোনী ও শালুটিকর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে বন্দিনী হয়ে আছে। পাক সেনাদের সীমাহীন অত্যাচারে দুঃসহ তাদের জীবন। কিন্তু মরার কোন উপায় নেই। পরণের শাড়ীগুলি পর্যন্ত পশুরা ছিনিয়ে নিয়েছে। গলায় দড়ি দেবার পর্যন্ত উপায় নেই। পরণে সামান্য একটা জাইঙ্গা আর ব্রেসিয়ার।

অর্ধনগ্ন এই সব মেয়েদের উপর রোজই চলে পাশবিক বলাৎকার। দানবের পৌনঃপুনিক ধর্ষণে ওরা বিধ্বস্ত। দস্যুরা বস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নিয়তই লুঠে নিচ্ছে ওদের মান সম্ভ্রম–কুমারীত্ব আর সতীত্বকে।

বুকফাটা কান্না চার দেয়ালে বাধা পেয়ে ওদের কাছেই আবার ফিরে আসে।

কে জানে তাদের মুক্তিকামী ভাই আর সন্তানেরা কবে তাদেরকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে”।

সিলেটের নারী আন্দোলনের অন্যতম প্রগতিশীল নেত্রী সাংসদ সৈয়দা জেবুন্নেসা হক ৭১-এর পরে বীরাঙ্গণাদের পুনর্বাসনের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। ড. এম এ হাসান এবং অপূর্ব শর্মা, দু’জনের বইতেই তার সেই সময়ের বর্ণনা উল্লেখ করা আছে। বর্ণনাটা লম্বা তবে এতে সিলেটের নারী নির্যাতনের পুরো একটা চিত্র মোটামুটি ফুটে উঠেছে।

“শহরে পাক আর্মির প্রধান ঘাঁটি মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ প্রভৃতি জায়গায় আমরা অনুসন্ধানে গিয়েছি। আর্মির এই ঘাঁটি এবং ক্যাম্পগুলোতে আমরা গণহত্যার ও নারী নির্যাতনের আলামত পেয়েছিলাম। ক্যাম্পের একটা দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা সেই বাক্যটি এখনও আমার চোখে ভাসে – “আমি আর বাঁচতে চাই না”। বিভিন্ন আলামত দেখে আমার মনে হয়েছে, মণিপুরী সম্প্রদায়ের মেয়েদেরই বেশী নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা সেখানে মণিপুরী মেয়েদের প্রচুর স্কার্ট, টপস ও অন্যান্য পোশাক পড়ে থাকতে দেখেছি। …

সিলেট এয়ারপোর্টে পাকিস্তানি আর্মির বাঙ্কার থেকে আমরা দু’জন জীবিত মেয়েকে উদ্ধার করেছিলাম। দু’টি মেয়েই ভীষণ অসুস্থ ছিল। তারা আমাদের জানিয়েছিল, দিনের পর দিন বাঙ্কারে আটকে রেখে পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের ওপর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে।

সে সময় বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় নির্যাতনের পর ধারালো বেয়নেট দিয়ে মেয়েদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। সিলেটে কিন্তু আমরা সেরকম দেখতে পাইনি। তবে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা দেখেছি, অনেক মেয়েকে বাবা মা’র সামনেই নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের সময় হয়তো বাবা মাকে বেঁধে রেখেছে, পরে তাদের হত্যা করেছে।

এভাবে সাহায্য করতে করতে আমরা অনেক নির্যাতিত মেয়ে পাই, যাদের জন্য পরে পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলতে হয়েছে। রায়নগরে এজন্য বঙ্গবন্ধু আমাদের একটা খালি বাড়ি দিয়েছিলেন। … এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমরা শুধু অন্তঃসত্ত্বা মেয়েই পেয়েছিলাম ৪৯ জন। সবাই পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিকতার শিকার”।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর জন্মস্থান সিলেটের বালাগঞ্জ ১৯৭১-এর ভয়াবহ সাক্ষর বহন করছে। বালাগঞ্জের ইলাশপুর, কৈলাশপুর, শেরপুর, বুরুঙ্গা ও আদিত্যপুরে প্রতিটা জায়গায় নিরীহ মানুষদের হত্যা করার পর নারীদের ওপর পাকিরা শুরু করে তাদের বর্বরতা। রাজাকার সাদ মিয়ার সহযোগীতায় মাত্র আঠারো দিনের ব্যবধানে বুরুঙ্গাতে ৭৮ জন ও আদিত্যপুরে ৬৩ জন কে হত্যা করা হয়। আদিত্যপুর গ্রামে গণহত্যা স্পটে তিনটি গুলি লাগা সত্ত্বেও বেঁচে যাওয়া শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের প্রথমে যে ঘরে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে আমি মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনেছি। বিভিন্ন নারী কন্ঠের চিৎকার শুনে মনে হয়েছে এখানে বহু নারীকে তারা নির্যাতন করেছে। এসব নির্যাতিত মেয়েদের মধ্যে এই গ্রামের সতীশের মেয়েরাও ছিল”।

স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জ পিটিআই-এর সম্মুখ প্রান্তরে যে বধ্যভূমির সন্ধান মিলে সেখানে শতাধিক কঙ্কাল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল বৃদ্ধ, যুবক, তরুণী ও যুবতীর লাশ। ক্যম্পের মধ্যেও পাওয়া যায় বিবস্ত্র অনেক মা-বোনের নিষ্প্রাণ দেহ। সুনামগঞ্জের জয়কলস গ্রামের রাজাকার সাত্তার পুরো একাত্তর জুড়েই পাকিদেরকে প্রতিদিন একজন করে নারী সরবরাহ করত। তারা সে কাজকে বলত ‘খাসির চালান”। জামালগঞ্জ থানার পিস কমিটির সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ ওরফে লাল মিয়ার একটা নিজস্ব প্রমোদতরী ছিল, নাম “ঝুনু এক্সপ্রেস”। এই তরী ব্যবহার করা হত পাকিদের লালসা নিবৃত্তির লক্ষ্যে। এর পর সে নারীদেরকে ভাসিয়ে দেয়া হত সুরমার পানিতে। কত বঙ্গ ললনার  লাশ যে এভাবে ভেসে গিয়েছে নদীর পানিতে তার কোন হিসেব নেই। এই দুই রাজাকারের কাজের বিস্তারিত ফিরিস্তি দেয়া আছে “সেই রাজাকার” নামক গ্রন্থে।

পাকিস্তানিরা বিয়ানীবাজারে ১৭ জন দালালের সমন্বয়ে গঠন করে মজলিশে শুরা, আবার সেই সদস্যদের আলাদা আলাদা দায়িত্ব ছিল। তবে এই ১৭ জনের মধ্যে পাকিস্তানীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল আবদুল হক ওরফে “কুটুমনা”। তার এই জনপ্রিয়তার কারণ একটাই, অবাধে নারী সরবরাহ এবং পাকিদের মতোই নারীভোগে আসক্তি। সে এলাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে তিনি ৪০০ জন নির্যাতিতা নারীকে চিকিৎসা করান, যাদের বেশীরভাগই কুটুমনার হাতে নির্যাতিত। বিয়ানীবাজারের আরেক দালাল শান্তি কমিটির সদস্য মৌলানা ছমির উদ্দীন জানান, ‘বিয়ানীবাজারে অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আর এ সব কাজের নেতা ছিল কুটুমনা। নিজে সে নারীদেহ ভোগ করত, পাকিস্তানি মিলিটারীদের সরবরাহ করতো এবং সে ব্যবসায়ে টাকাও কামাতো দু’হাতে”।

তাজুল মোহাম্মদের ‘আলবদরের ডাইরি’ বইটা বের হয় ২০১১ সালে। সে বইয়ের তথ্য অনুসারে কুটুমনা বর্তমানে লন্ডনে থাকে এবং সেখানে এক মসজিদে নিয়মিত ইসলামের সবক প্রদান করে।

সিলেটের প্রতিটা চা বাগানে গণহত্যার পাশাপাশি চালানো হয় ব্যাপক নারী নির্যাতন। তারাপুর চা বাগানে গণহত্যা চালানোর পর আর্মি এসে তুলে নিয়ে যায় বাগানের মালিক রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের তিন মেয়েকে। পরে ক্ষতবিক্ষত দেহে তিন বোনকে নামিয়ে দিয়ে যায়। খাদিমনগর চা বাগানে ধর্ষিত হয় অসংখ্য চা শ্রমিক। নির্যাতিত বাতাসিয়া রুহিদা সহ বহু মহিলাই চলে গেছেন দেশ ছেড়ে।

চা শ্রমিকরা ধর্ষণকে “বেইজ্জত” বলে। পার্বতী বুনারজী তখন কালাগুল চা বাগানে স্বামী সন্তান সহ সবাইকে নিয়ে কাজ করতেন। এক মধ্যরাতে পাকি আর্মিরা তাদের ঘরে ঢুকে। তিনি বলেন,“সে রাতে একজন আর্মিই আমার ঘরে ঢুকেছিল। সে ঢুকেই ঘরের দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। … আমার স্বামীর সঙ্গে ঐ মিলিটারির খুব ধস্তাধস্তি হয়। …শেষ পর্যন্ত আমার স্বামী আমার শরীরের ওপর শুয়ে পড়ে আমাকে আগলাতে চেষ্ট করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। ওরা জোর করে আমাকে নির্যাতন করেছে।[…] আমাকে ছাড়াও কালাগুল চা বাগানের আরও অনেক মহিলাকে পাকি আর্মিরা সে সময় নির্যাতন করেছিল। আমার সামনের ঘরের এক মহিলাকেও তারা বেইজ্জত করেছিল। দু’টো বউ ছিল ঐ বাড়িতে। একজন তো ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে  নিজের ইজ্জত রক্ষা করেছে। আর একজনকে তারা ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে নির্যাতন করেছে…।”

শ্রীমঙ্গল চা বাগানের পুণ্যবতী ঘাসী বলেছিলেন, “নির্যাতনের কিছু বাকী রেখেছে নাকি? দশটার সময় তো আমাকে আটকালো। আর বারোটার দিকে একজন আর্মি ঘরে ঢুকে আমাকে ধর্ষণ করল। তখন বাইরে আরো দশ বারোজন আর্মি দাঁড়িয়েছিল।… তাদের কোন কথাবার্তা লাগত না। তারা ধরবে, পটাকবে (ফেলে দিবে) তারপর ইজ্জত সম্মান মেরে যাবে। খেজুরিছড়ার লক্ষী নামের একটা মেয়েকে আকেবারে আমার চোখের সামনে নির্যাতন করে শেষ করে দিল।”

শ্রীমঙ্গলের হরিণছড়া, খেজুরিছড়া ও ফুলছড়া- এই তিনটি বাগানেই কমপক্ষে একশ জন নারী পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষিত হন।

চুনারুঘাটের সুপ্রিয়া নায়েক তখন লষ্করপুর বাগানের থাকতেন। ৭১-এ তার বয়স ছিল ১৬ বছর। পাকি জানোয়াররা তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। বাগানের ফ্যাক্টরী তখন পাকিদের ক্যাম্প। সেখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে তাকে নিয়ে যাওয়া হত। চানপুর বাগানের চন্ডীরকীনার বাংলোতে তারা অনেক মেয়েকে আটকে রেখেছিল। “বিভিন্ন ক্যাম্পের আর্মি অফিসাররা এই বাংলোর ক্যাম্পে এসে আমাকে ধর্ষণ করতো। প্রতিরাতে চার-পাঁচজন করে পাকি আর্মি আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছে। কোন রাতেই তারা আমাকে নিষ্কৃতি দেয়নি।” বন্দী কয় মাসে অন্তত ৫০ জনের মতো পাকিস্তানি অফিসার তাকে ধর্ষণ করে।

ভাড়াউড়া চা বাগানে ভয়ংকর নারী নির্যাতন চালানো হয়। ৫০ জনের অধিক শ্রমিক এই বাগানে চালানো গণহত্যায় শহীদ হওয়ার পর শুধুমাত্র এই চা বাগানেই ৪৫ জন নারী আর্মিদের ধর্ষণের শিকার হন। সেই ধর্ষণের বিভৎসতা ফুটে উঠে গণহত্যা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কেদারলাল হাজরার কথায়, “এমনকি ৫০-৬০ বছরের বৃদ্ধাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি।”

ফুলছড়া চা বাগানের মুটারী নামক একটা দেশোয়ালী মেয়েকে বাগানের ভেতরের দিকে নিয়ে গিয়ে তিনজন আর্মি পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল। সেখানে বাগান থেকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করা হত মেয়েদের। কুমারী মৃধা জানান, “শিশিরবাড়ি বাগানের এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বেশি। আর্মিদের অত্যাচারে সেখানকার একজন মেয়ে মারা গিয়েছিল। বাগানের লোকজনের সামনেই তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।”

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, অপূর্ব শর্মা’র ‘বীরাঙ্গনা কথা’ বইটা সিলেট অঞ্চলের কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে। মাঠপর্যায়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে হাজারটা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে অপূর্ব শর্মা তাঁদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। সে কাজের জন্যে প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটা পরিচয় তিনি বইয়ের ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছেন। একদিকে তিনি নিজে পুরুষ হওয়ার কারনে এটা তাঁর কাছে মোটেও সহজ ছিল না। আবার অন্যদিকে, অনেকেই অপবাদ কিংবা পারিবারিক দুর্নামের ভয়ে কথা বলতেও চাননি। একাধিকবার সব হারানোর পর নতুন কোন বিড়ম্বনাতেও তাঁরা পড়তে চাননি।

অপূর্ব শর্মা’র সেই বইয়ে বর্ণিত দু’জন বীরাঙ্গনার কথা বলি। একজন হচ্ছেন সাফিয়া খাতুন। তাঁর জন্ম কুমিল্লার শিদলাই গ্রামে; দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট সাফিয়া বাবা-মার সাথে শৈশবে পাড়ি জমান মৌলভীবাজারে। যুদ্ধের বছর সাতেক আগে বিয়ে হয় সাফিয়ার। স্বামী আর দেবরের সাথে যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতেন; রান্না করে খাওয়াতেন মুক্তিবাহিনীকে। স্থানীয় দালালদের সহায়তায় তার বাড়িতে একদিন হাজির হয় পাকিরা, সময়টা তখন আশ্বিন মাস। স্বামী সন্তানদের নির্যাতন করে ফেরার সময় গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায় সাফিয়াকে। স্থানীয় ক্যম্পে চারদিন রেখে নিয়ে যাওয়া হয় লাতুতে। সেই ক্যাম্পে তাকে রাখা হয় আরো ১২ দিন। এভাবে একের পর এক ক্যাম্পে তাকে নিয়ে উন্মত্ততায় মেতে উঠত পাকি জানোয়াররা। তিনি নিজের মুখে বলেন,“কিতা কইতাম লজ্জার কথা। মনে অইলে গা শিউরে উঠে। ঐদিন রাত ১০ টায় পাঁচজন পাক সৈন্য এসে আমাকে উলঙ্গ হতে বলে। আমি দুই হাত দিয়ে শাড়ি সমেত শরীরডারে শক্ত কইরা ধরি। আমারে লাত্থি দিয়া একজন মাটিতে ফালাই দেয়। এদের সবাই আমার সাথে সেই রাতে খারাপি করে। আমারে রক্তাক্ত কইরা চইলা যায়। সেই রাতে আমি চোখের জলে বুক ভাসাইছি। আর আল্লারে ডাকছি, আল্লাহ আমারে নেওনা কেনেরেবা। হেরা বুলে পাকিস্তানি, হেরা বুলে মুসলমান!”

তথ্য আদায়ের নামে ধর্ষণের পাশাপাশি তার উপর চলে আরো নির্যাতন। সে নির্যাতনে তার ডান পায়ের চারটি আঙ্গুল, ডান হাতের নির্দেশিকা ও ডান হাতের কব্জি ভেঙ্গে যায়। তিনি আরো বলেন, “আমি নিজেও এইরকম নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছি। লাতুতে আমার সামনেই গুলি কইরা আটটি মেয়েকে হত্যা করেছে তারা।”

অপরজন হচ্ছেন এসনু বেগম। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর হলেও যে ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেয়া হয়েছে, সেখানে তাঁর নামও আছে। এসনু বেগমের বড় দুই বোনের তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তাঁর বয়স ১৩ কিংবা ১৪। প্রাইমারী স্কুলের পরে আর পড়ালেখা হয় নাই, থাকতেন বাবা-মায়ের সাথে জকিগঞ্জের বারহাল ইউনিয়নে। যুদ্ধের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থায় এক রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানিরা তাকে তুলে নিয়ে যায় শাহগলির পাকিস্তানি ক্যম্পে। শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তিনি বলেন, “সংগ্রামের বরছ (বছর) আমি হুরু আছলাম। দুই বনির (বোনের) বিয়া অইগেলে আমি অইলাম একলা। একদিন মাজরাইতে আকতা (হঠাৎ) কয়জন রাজাকার মিলিটারী লইয়া আমরার বাড়ীঘর গেরাও কইরা মা-বাপর সামনে আমার চউখ বাইন্দা ফালায়। পরে জোরে ধইরা আমারে তাদের ক্যাম্পে লইয়া যায়।”

চারদিন পরে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। “বাড়ীতে আওনের বাদে লজ্জায় লোকজনের সামনে বাইর হইতে পারতাম নায়। মুখ সবসময় কাপড় দি ডাইক্কা রাখতাম। মাইনষের কত বাদ বাদ (খারাপ) কথা হুনতে অইছে।” বিয়ে হয়েছিল; এক বয়োবৃদ্ধের সাথে। দুই সন্তানের জননীও হয়েছিলেন, জন্মের পরপরই তারাও মারা যায়। চিকিৎসার অভাবে স্বামীও মারা যান কয়দিন পরই। একসময় পিতা মাতাকে হারিয়ে পুরো একা হয়ে যান এই নারী। একসময় হারিয়েছিলেন সম্ভ্রম, পরে হারিয়েছিলেন আত্নীয়-স্বজন সবাইকে।

শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সুনির্দিষ্ট কারণেই গবেষকরা নির্দিষ্ট সংখ্যা না বলে অনেক জায়গাতেই বলেছেন, ‘এ জায়গায় ব্যাপক নারী ধর্ষণ করা হয়’। তাজুল মোহাম্মদ ‘সিলেটে গণহত্যা’ বইতে মোটামুটি প্রতিটা গ্রাম সম্পর্কেই আলোচনা করেছেন। অনেক স্থানেই তিনি ‘ব্যাপক নারী ধর্ষণ’ এর কথা উল্লেখ করেছেন।

যুদ্ধের নির্যাতিতা এ সকল নারীর কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন ভারতে, কেউবা পরবর্তীতে চেপে গিয়েছেন পুরো ঘটনা। আর যাদের ঘটনা জানাজানি হয়েছিল, তাদেরকে আমরা ফেলে দিয়েছিলাম আরেক নতুন মৃত্যুকূপে। সমাজে যতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা যায় ঠিক ততটাই করা হয়েছে তাদের সাথে। দারিদ্র্যের কষাঘাত এবং সমাজের ঘৃণ্য আক্রমণ তাদেরকে একাত্তরের দুঃসহ যাতনার কথা কখনোই ভুলতে দেয় না, উল্টো প্রতিনিয়তই তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সে যন্ত্রণা। এই বাঙালি সমাজ থেকে কতটা কষ্ট পেলে একজন বলতে পারেন,“সবার সঙ্গে সেদিন মরতেও পারতাম। সেটাই বোধহয় ভালো হতো। কষ্ট–যাতনা আর উপহাস সইতে হতো না। আর ভাল্লাগে না। একদম ভালো লাগে না”।  

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থে একজন বীরাঙ্গনা বলেছিলেন, “একটি মূহুর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুন অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কন্ঠ আছে। এ দেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মূহুর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।”

স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিৎ, বীরাঙ্গনাদের সেই স্বপ্নের, সেই আকাঙ্ক্ষার কতখানি পূর্ন করতে পেরেছি আমরা?

তথ্যসূত্রঃ
১) যুদ্ধ ও নারী – ডা এম এ হাসান
২) সিলেটে গণহত্যা –তাজুল মোহাম্মদ
৩) আলবদরের ডায়রি – তাজুল মোহাম্মদ
৪) বীরাঙ্গনা কথা – অপূর্ব শর্মা
৫) সেই রাজাকার
৬) বীরাঙ্গনা ১৯৭১ – মুনতাসির মামুন
৭) গনমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসির মামুন ও হাসিনা আহমদ
৮) আমি বীরাঙ্গনা বলছি –  নীলিমা ইব্রাহিম
৯) চা বাগানে পাক গণহত্যা-পৈশাচিক বর্বরতা – সহুল আহমদ, RTV Online, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn